March 2019


হযরত মুসা (আঃ)
(খ্রীষ্ট পূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দী)

প্রাচীন মিশরের রাজধানী ছিল পেণ্টাটিউক। নীল নদের তীরে এই নগরে বাস করতেন মিশরের “ফেরাউন”
রামেসিস। নগরের শেষ প্রান্তে ইহুদিদের বসতি। মিশরের “ফেরাউন” ছিলেন ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন। একবার কয়েকজন জ্যোতিষী গণনা করে তাকে বলেছিলেন, ইহুদি পরিবারের মধ্যে এমন এক সন্তান জন্মগ্রহণ করবে যে ভবিষ্যতে মিশরের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। জ্যোতিষীদের কথা শুনে ভীত হয়ে পড়লেন ফিরাউন। তাই ….. আদেশ দিলেন কোন ইহুদি পরিবারে সন্তান জন্মগ্রহণ করলেই যেন হত্যা করা হয়। …… এর গুপ্তচররা চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াত। যকনই কোন পরিবারে সন্তান জন্মবার সংবাদ পেত তখনই গিয়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করত।
ইহুদি মহল্লায় বাস করতেন আসরাম আর জোশিবেদ নামে এক সদ্যবিবাহিত দম্পতি। যথাসময়ে জোশিবেদের একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করল। সন্তান জন্মাবার পরই স্বামী-স্ত্রীর মনে হল যেমন করেই হোক এই সন্তানকে রক্ষা করতেই হবে। কে বলতে পারে এই সন্তানই হয়ত ইহুদি জাতিকে সমস্ত নির্যাতন থেকে রক্ষা করবে একদিন।
সকলের চোখের আড়ালে সম্পূর্ণ গোপনে শিশুসন্তানকে বড় করে তুলতে লাগলেন আসরাম আর জোশিবেদ। কিন্তু বেশিদিন এই সংবাদ গোপন রাখা গেল না। স্বামী-স্ত্রী বুঝতে পারলেন যে কোন মুহূর্তে ……-এর সৈনিকরা এসে তাদের সন্তানকে তুলে নিয়ে যাবে। ঈশ্বর আর ভাগ্যের হাতে শিশুকে সঁপে দিয়ে দুজন বেরিয়ে পড়লেন। নীল নদের তীরে এক নির্জন ঘাটে এসে শিশুকে শুইয়ে দিয়ে তারা বাড়ি ফিরে গেলেন।
সেই নদীর ঘাটে প্রতিদিন গোসল করতে আসত ….. কন্যা। ফুটফুটে সুন্দর একটা বাচ্চাকে একা পড়ে থাকতে দেখে তার মায়া হল। তাকে তুলে নিয়ে এল রাজপ্রাসাদে। তারপর সেই শিশু সন্তানকে নিজের সন্তানের মত স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে মানুষ করে তুলতে লাগল। রাজকন্যা শিশুর নাম রাখল মুসা।
এ বিষয়ে আরেকটি কাহিনী প্রচলিত। মুসার মা জোশিবেদ জানতেন প্রতিদিন ……-এর কন্যা সখীদের নিয়ে নদীতে স্নান করতে আসেন। একদিন ঘাটের কাছে পথের ধারে শিশু মুসাকে একটা ঝুড়িতে করে শুইয়ে রেখে দিলেস। নিজে গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর রাজকুমারী সেই পথ দিয়ে স্নান করতে যাবার সময় দেখতে পেল মুসাকে। পথের পাশে ফুটফুটে একটা শিশুকে পড়ে থাকতে দেখে তার মায়া হল। তাড়াতাড়ি মুসাকে কোলে তুলে নিল। জোশিবেদকেই মুসার ধাত্রী হিসেবে নিয়োগ করে রাজকুমারী। নিজের পরিচয় গোপন করে রাজপ্রাসাদে মুসাকে দেখাশুনা করতে থাকে জোশিবেদ। মা ছাড়া মুসা কোন নারীর স্তন্যপান করেনি।ধীরে ধীরে কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিলেন মুসা। ফিরাউনের অত্যাচার বেড়েই চলছিল। ইহুদির উপর এই অত্যাচার ভাল লাগত না মুসার। পুত্রের মনোভাব জানতে পেরে একদিন জোশিবেদ তার কাছে নিজের প্রকৃত পরিচয় দিলেন। তারপর থেকে মুসার অন্তুরে শুরু হল নিদারুণ যন্ত্রণা।
একদিন রাজপথ দিয়ে যাচ্ছিলেন মুসা। এমন সময় তার চোখে পড়ল এক হতভাগ্য ইহুদিকে নির্মমভাবে প্রতার করছে তার মিশরীয় মনিব। এই দৃশ্য দেখে আর স্থির থাকতে পারলেন না মুসা। তিনি সেই ইহুদিকে উদ্ধার করবার জন্য নিজের হাতে তরবারী দিয়ে আঘাত করলেন মিশরীয় মনিবকে। সেই আঘাতে মারা গেল মিশরীয় লোকটি। ইহুদি লোকটি চারদিকে এ কথা প্রকাশ করে দিল। গুপ্তচররা …….. গিয়ে সংবাদ দিতেই ক্রোধে ফেটে পড়লেন …….।তিনি বুঝতে পারলেন রাজকন্যা মুসাকে মাসুষ করলেও তার শরীরে বইছে ইহুদির রক্ত, তাই নিজের ধর্মের মানুষের উপর অত্যাচার হতে দেখে মিশরীয়কে হত্যা করেছে। একে যদি মুক্ত রাখা হয় তবে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। তখনই সৈনিকদের ডেকে হুকুম দিলেন, যেখান থেকে পারো মুসাকে বন্দী করে নিয়ে এসো।
…… – এর আদেশে কথা শুনের আর বিলম্ব করলেন না মুসা। তৎক্ষণাৎ নগর ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়লেন। দীর্ঘ পথশ্রমে মুসা ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর চোখে পড়ল দূরে একটি কুয়ো। কুয়োর সামনে সাতটি মেয় তাদের ছেড়াকে পানি খাওয়াচ্ছিল । হঠাৎ একদল মেষপালক সেখানের এসে মেয়েদের কাছ থেকে জোর করে ভেড়াগুলিকে কেড়ে নিল। সাথে সাথে চিৎকার -চেচাঁমেচি শুরু করে দিল সাতবোন। তাদের চিৎকার শুনে ছুটে এলেন মুসা। তারপর মেষপালকেদের কাছ থেকে সবকটা ভেড়া উদ্ধার করে মেয়েদের ফিরিয়ে দিলেন। মেয়েরা তাঁকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ি ফিরে গেল।
সাত বোনের বাবার নাম ছিল রুয়েন। সাত বোন এসে মুসাকে ডেকে নিয়ে গেল। তাদের বাড়িতে। তাঁর পরনের মূল্যবান পোশাক, সম্ভ্রমপূর্ণ ব্যবহার দেখে সকলেই মুগ্ধ হয়ে গেল। রুয়েন তার পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই কোন কথা গোপন করলেন না মুসা। অকপটে নিজের পরিচয় দিলেন। রুয়েন মুসার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিল। অল্প কিছুদিন পর এক মেয়ের সাথে তাঁর বিয়ে দিল রুয়েন।
সেই যাযাবর গোষ্ঠীর সাথে থাকতে থাকতে অল্প দিনেই মেষ চরানোর কাজ শিখে নিলেন মুসা। এক নতুন পরিবেশের সাথ সম্পূর্ণভাবে নিজেকে মানয়ে নিলেন। দেখতে দেখতে বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। ওদিকে মিশরে ইহুদিদের অবস্থা ক্রমশই দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। মিডিয়াতে পশুপালকের জীবন যাপন করলেও স্বজাতির কথা ভুলতে পারেননি মুসা। মাঝে মাঝেই তাঁর সমস্ত অন্তর ব্যথিত হয়ে উঠত।
একদিন মেষের পাল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নির্জন পাহাড়ের প্রান্তে এসে পৌঁছলেন মুসা। সামনেই বেশ কিছু গাছপালা। হঠাৎ মুসা দেখলেন সেই গাছপালা পাহাড়ের মধ্যে থেকে এক আলোকছটা বেড়িয়ে এল। এত তীব্র সেই আলো, তার মনে হল ঐ আলো যেন তাঁকে আচ্ছান্ন করে ফেলছে। েএক সময় শুনতে পেলেন সেই আলোর মধ্যে থেকে এক অলৌকিক কণ্ঠস্বর ভেসে এল: মুসা মুসা।
চমকে উঠলেন মুসা। কেই তাঁরই নাম ধরে ডাকছে। তৎক্ষণাৎ সাড়া দিলেন, কে আপনি আমায় ডাকছেন? সেই অলৌকিক কষ্ঠস্বর বলে উঠল, আমি তোমার ও তোমার পূর্বপুরুষদের একমাত্র ঈশ্বর। ঈশ্বর তাঁর সাথে কথা বলছেন, এ যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না মুসা। ভীত হয়ে মাটিতে নতজানু হয়ে বসে পড়লেন। আমার কাছে আপনার কি প্রয়োজন প্রভু?
দৈবকণ্ঠস্বর বলল, তুমি আমার প্রতিনিধি হিসেবে মিশরে যাও। সেখানে ইহুদিরা অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করছে। তুমি ইহুদিদের মুক্ত করে নতুন দেশে নিয়ে যাবে। মুসা বললেন, আমি কেমন করে তাদের মুক্তি দেব?
দৈববাণী বলল, আমি অদৃশ্যভাবে তোমাকে সাহায্য করব। তুমি ফিরাউনের কাছে গিয়ে বলবে, আমিই তোমাকে প্রেরণ করেছি। সকলেই যেন তোমর আদেশ মেনে চলে।
মুসা বললেন, কিন্তু যখন তারা জিজ্ঞেস করবে ঈশ্বরের নাম, তখন কি জবাব দেব?
প্রথমে ঈশ্বর তাঁর নাম প্রকাশ না করলেও পরে বললেন তিনিই এই বিশ্বজগতের স্রষ্টা আল্লাহ। মুসা অনুভব করলেন তাঁর নিজের শক্তিতে নয়, ঈশ্বর প্রদত্ত শক্তিতেই তাঁকে সমস্ত কাজ সমাধান করতে হবে। এতদিন ঈশ্বর সম্বন্ধে তাঁর কোন স্পষ্ট ধারণা ছিলনা। এই প্রথম অনুভব করলেন ঈশ্বর-নির্দিষ্ট কাজের জন্যই তিনি পৃথিবীতে এসেছেন। আর আল্লাহ তাঁর একমাত্র ঈশ্বর । এর কয়েকদিন পর দ্বিতীয়বার ঈশ্বরের আদেশ পেলেন মুসা। তিনি পুনরায় আবির্ভূত হলেন মুসার সামনে। তারপর বললেন, তোমার উপর আমি প্রসন্ন হয়েছি । একমাত্র তুমিই পারবে ই্হুদি জাতিকে এই সংকট থেকে উদ্ধার করতে । আর বিলম্ব করো না, যত শীঘ্র সম্ভব রওনা হও মিশরে । অল্প কয়েকদিন পর স্ত্রী-সন্তানদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে মিশরের পথে যাত্রা করলেন মুসা ।
যথাসময়ে মিশরে গিয়ে পৌঁছলেন মুসা । গিয়ে দেখলেন সত্যি সত্যি ইহুদিরা অবর্ণনীয় দুরবস্থার মধ্যে বাস করছে ।
মুসা প্রথমেই সাক্ষাৎ করলেন ইহুদিদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে । তাদের সকলকে বললেন ইশ্বরের আদেশের কথা । মুসার আচার-আচরণ, তাঁর ব্যক্তিত্ব, আন্তরিক ব্যবহার, গভীর আত্মপ্রত্যয় দেখে সকলেই তাঁকে বিশ্বাস করল ।
মুসা বললেন,আমরা “ফেরাউন” –এর কাছে গিয়ে দেশত্যাগ করবার অনুমতি প্রার্থনা করব। মুসা তার ভাই এ্যাবন ও কয়েকজন ইহুদি নেতাকে সাথে নিয়ে গিয়ে হাজির হলেন “ফেরাউন” –এর দরবারে।  মুসা জানতেন সরাসরি দেশত্যাগ করবার অনুমতি চাইলে ফেরাউন সেই অনুমতি দেবেন না । তাই তিনি বললেন, সম্রাট, আমাদের স্রষ্টা আদেশ দিয়েছেন সমস্ত ইহুদিকে মিডিয়ার মরুপ্রান্তরে এক পাহাড়ে গিয়ে প্রার্থনা করতে । আপনি যদি কয়েকদিনের জন্য সেখানে যাবার অনুমতি দেন ।
ফেরাউন মুসার অনুরোধে সাড়া দিলেন । ক্রদ্ধ স্বরে বলে উঠলেন , তোমাদের আল্লাহর আদেশ আমি মানি না । তোমরা মিশর ত্যাগ করে কোথাও যেতে পারবে না ।
মুসা বললেন, আমরা যদি মরুভূমিতে গিয়ে প্রার্থনা না করি তবে তিনি আমাদের উপর ক্রুদ্ধ হবেন । হয়ত আমাদের সকলকেই ধ্বংস করে ফেলবেন ।
ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এলেন মুসা । কি করবেন কিছুই ভাবতে পারছিলেন না । শেষে নিরুপায় হয়ে আল্লাহর কাছে আকুল হয়ে প্রার্থনা করলেন । তার প্রার্থনায় সাড়া দিলেন আল্লাহ । তিনি মুসাকে বললেন, তোমার ভাই এ্যারনকে বল, সে যেন নদী,জলাশয়,পুকুর ঝর্ণায় গিয়ে তার জাদুদন্ড স্পর্শ করে, তাহলেই দেখবে সমস্ত পানি রক্ত হয়ে গিয়েছে ।
আল্লাহর নির্দেশে এ্যারন মিশরের সমস্ত পানীয় জলকে রক্তে রূপান্তরিত করে ফেলল । ফ্যারাও আদেশ দিলেন মাটি খুড়ে পানি বার কর ।
সৈনিকরা অসংখ্য কূপ খুঁড়ে ফেলল । সকলে সেই জল পান করতে আরম্ভ করল । এ্যারনের জাদু বিফল হতেই মুসা পুনরায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন ।
এইবার মিশর জুড়ে ব্যাঙের মহামারী দেখা গেল । তার পচা গন্ধে লোকের প্রাণান্তরক অবস্থা কেউ আর ঘরে থাকতে পারে না । সকলে গিয়ে “ফেরাউন” –এর কাছে নালিশ জানাল । নিরুপায় হয়ে “ফেরাউন” ডেকে পাঠালেন মুসাকে । বললেন, তুমি ব্যাঙের মড়ক বন্ধ কর । আমি তোমাদের মরুভূমিতে গিয়ে প্রার্থনা করবার অনুমতি দেব ।
মুসার ইচ্ছায় ব্যাঙের মড়ক বন্ধ হলেও ফ্যারাও নানান অজুহাতে ইহুদিদের যাওয়ার অনুমতি দিলেন না । নিরুপায় হয়ে মুসা আবার আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন । ফ্যারাওয়ের আচরণে এই বার ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন আল্লাহ । সমস্ত মিশর জুড়ে ঝড় ঝঞ্চা বৃষ্টি মহামারী । তবুও “ফেরাউন” অনুমতি দিতে চান না ।
এইবার আল্লাহ নির্মম অস্ত্র প্রয়োগ করলেন । হঠাৎ সমস্ত মিশরীয়দের প্রথম পুত্র সন্তান মারা পড়ল । দেশজুড়ে শুরু হল হাহাকার । সমস্ত মিশরীয়রা দলবদ্ধভাবে গিয়ে “ফেরাউন” –এর কাছে দাবি জানাল, ইহুদিদের দেশ ছাড়ার অনুমতি দিন, না হলে আরো কি গুরুতর সর্বনাশ হবে কে জানে । ভয় পেয়ে গেলেন ফ্যারাও । “ফেরাউন” মুসাকে ডেকে বললেন, প্রার্থনা করবার জন্য তোমাদের মরুভূমিতে যাবার অনুমতি দিচ্ছি । যদি ,মনে কর, তোমাদের যা কিছু আছে, গৃহপালিত গবাদি পশু,জীবজন্তু,জিনিসপত্র, সব সাথে নিয়ে যেতে পার ।
দেশত্যাগের অনুমতি পেয়ে ইহুদিরা সকলেই উল্লসিত হয়ে উঠল । তারা সকলেই মুসাকে তাদের নেতা বলে স্বীকার করে নিল । মিশর ছাড়াও মাকুম নগরেও বহু ইহুদি বাস করত । সকলে দলবদ্ধভাবে মুসাকে অনুসরণ করল ।
মুসা জানতেন আল্লাহর শাস্তির ভয়ে ফ্যারাও দেশত্যাগের অনুমতি দিলেও তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করবেন যাতে তাদের যাত্রাপথে বিঘ্ন সৃষ্টি করা যায় । তাই যথাসম্ভব সতর্ক ভাবে পথ চলতে লাগলেন । কয়েকদিন চলবার পর তারা সকলে এসে পড়ল লোহিত সাগরের তীরে । এদিকে ইহুদিরা মিশর ত্যাগ করতেই “ফেরাউন” –এর মনের পরিবর্তন ঘটল। যেমন করেই হোক তাদের ফিরিয়ে নিয়ে এসে আবার ক্রীতদাসে পরিণত করতে হবে । তৎক্ষণাৎ ইহুদিদের বন্দী করবার জন্য বিশাল সৈন্যবাহিনীকে পাঠালেন “ফেরাউন” ।
এদিকে দূর থেকে মিশরীয় সৈন্যদের দেখতে পেয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল সমস্ত ইহুদিরা । সামান্যতম বিচলিত হলেন না মুসা ।
প্রার্থনায় বসলেন মুসা । প্রার্থনা শেষ হতেই দৈববাণী হল, মুসা, তোমার হাতের দন্ড তুলে সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে যাবে । সমুদ্রের পানি তোমাদের স্পর্শ করবে না ।
মুসা তাঁর হাতের দণ্ড তুলে সমুদ্রের সামনে এসে দাঁড়াতেই সমুদ্র দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল। তার মধ্যে দিয়ে প্রসারিত হয়েছে প্রশান্ত পথ। সকলের আগে মুসা, তার পেছনে সমস্ত ইহুদি-নারী-পুরুষের দল সেই পথ ধরে এগিয়ে চলল। তারা কিছুদুর যেতেই মিশরীয় সৈন্যরা এসে পড়ল সমুদ্রের তীরে। ইহুদিদের সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে যেতে দেখে তারাও তাদের অনুসরণ করে সেই পথ ধরে এগিয়ে চলল। সমস্ত মিশরীয় বাহিনী সমুদ্রের মধ্যে নেমে আসতেই আল্লাহর নির্দেশ শুনতে পেলেন মুসা, তোমার হাতের দণ্ড পেছন ফিরে নামিয়ে দাও।
মুসা তাঁর হাতের দণ্ড নিচু করতেই সমুদ্রের জলরাশি এসে আছড়ে পড়ল মিশরীয় সৈন্যদের উপর। মুহূর্তে বিশাল সৈন্যবাহিনী সমুদ্রের অতল গহরে হারিয়ে গেল। ইহুদিরা নিরাপদে তীরে গিয়ে উঠল। মুসা সকলকে নিয়ে এগিয়ে চললেন। সামনে বিশাল মরুভুমি। সামান্য পথ অতিক্রম করতেই তাদের সঞ্চিত পানি, খাবার ফুরিয়ে গেল। মরুভুমির বুকে কোথাও পানির চিহ্নমাত্র নেই। ক্রমশই সকলে তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ছিল। অনেকে আর অগ্রসর হতে চাইছিল না।
মুসা বিচলিত হয়ে পড়লেন, এতগুলো মানুষকে কোথা থেকে তৃষ্ণার পানি দেবেন। কিছুদূর যেতেই এক জায়গায় পানি পাওয়া গেল । এত দুর্গন্ধ সেই পানি কার সাধ্য তা মুখে দেয় । প্রার্থনায় বসলেন মুসা । প্রার্থনা শেষ করে আল্লাহর নির্দেশে কিছু গাছের পাতা ফেলে দিলেন সেই পানির ভিতরে । সাথে সাথে সেই পানি সুস্বাদু হয়ে উঠল । সকলে তৃষ্ণা মিটিয়ে সব পাত্র ভরে নিল ।  যারা মুসাকে দোষারোপ করছিল, তারা অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইল । সকলে মুসাকে তাদের ধর্মগুরু ও নেতা হিসেবে স্বীকার করে নিল । সকলে তাঁর নির্দেশ মত এগিয়ে চলল । কিছুদিনের মধ্যেই সমস্ত খাবার ফুরিয়ে গেল । আশে পাশে কোথাও কোন খাবারের কোন সন্ধান পাওয়া গেল না । খিদের জ্বালায় সকলেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল । আবার তারা দোষারোপ করতে আরম্ভ করল মুসাকে । তোমার জন্যই আমাদের এত কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে ।
মুসা সকলকে শান্ত করে বললেন, তোমরা ভুলে গিয়েছ আমাদের ইশ্বর আল্লাহর কথা । তিনি “ফেরাউনকে” তোমাদের দেশত্যাগের অনুমতি দিতে বাধ্য করেছেন ।তিনি সমুদ্রকে দ্বিধাবিভক্ত করেছেন,সৈন্যদের হাত থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন । তোমাদের পানির ব্যবস্থা করেছেন । তবু ও তোমরা তাঁর শক্তিকে সন্দেহ প্রকাশ করছ ।
মুসার কথা শেষ হতেই কোথা থেকে সেখানে উড়ে আসে অসংখ্য পাখির ঝাঁক । ইহুদিরা ইচ্ছামত পাখি মেরে মাংস খায় । আর কারো মনে কোন সংশয় থাকে না । সকলে শপথ করে জীবনে মরণে তারা মুসার সমস্ত আদেশ মেনে চলবে ।
মুসা সমস্ত ইহুদিদের নিয়ে এলেন এফিডিম নামে এক নির্জন প্রান্তে । চারদিকে ধু ধু বালি, মাঝে মাঝে ছোট পাহাড়, কোথাও পানীর কোন উৎস নেই ।
মুসা আবার এগিয়ে চললেন । কিছুদূর গিয়ে একটা বড় পাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন । আল্লাহর নির্দেশে পাথর সরাতেই বেরিয়ে এল স্বচ্ছ পানির এক ঝর্ণাধারা । সেই পানিতে সকলের তৃষ্ণা মিটল। মুসা যেখানে এসেছিলেন তার অদূরেই প্যালেস্তাইনে তখন বাস করতেন আমালেক নামে এক উপজাতি সম্প্রদায় । নতুন একদল মানুষকে তাদের অঞ্চলে প্রবেশ করতে দেখে তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল । অপরদিকে ইহুদিরা দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত,পরিশ্রান্ত, অবসন্ন, সকলে মুসাকে বলল, এই যুদ্ধে আমাদের নিশ্চিত পরাজয় হবে । তুমি অন্য কোথাও আশ্রয়ের সন্ধানে চল । মুসা সকলকে সাহস দিয়ে তাঁর দলের সমস্ত পুরুষদের একত্রিত করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। যুদ্ধ পরিচালনার ভার দেওয়া হল জোশুয়া নামে এক সাহসী যুবককে । শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ মুসা নিজে ‍যুদ্ধে যোগ দিলেন । আল্লাহর নির্দেশে পাহাড়ের উপর উঠে তাঁর হাতের দন্ড আকাশের দিকে তুলে ধরলেন । ‍যুদ্ধর প্র্রথমে আমালেকরা ইহুদিদের বিপর্যস্ত করেছিল । কিন্তু মুসা তাঁর দ্ন্ড উর্ধ্বাকাশে তুলে ধরতেই যুদ্ধের গতি পরিবর্তন হল । ইহুদিরা বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমালেকদের উপর । ইহুদিদের সেই প্রচন্ড বিত্রম সহ্য করতে পারল না আমালেকরা । বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত হয়ে তারা পালিয়ে গেল ।
ইহুদিরা নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলল প্যালেস্তাইনের দিকে । পথে সিনাই পর্বত । এখানে পানি ও গাছপালার কোন অভাব নেই  মুসা সেখানেই সকলকে তাবু খাটাবার নির্দেশ দিলেন ।
সেই সময় মুসার শ্বশুর জেথ্রো তার স্ত্রী, দুই পুত্র,সঙ্গী সাথীদের নিয়ে সেই পথ ধরে যাচ্ছিল । কাছে আসতেই বুঝতে পারলেন এরা দেশত্যাগী ইহুদি জাতি । তার জামাই এর নেতৃত্বে এখানে বসতি স্থাপন করেছেন ।
জেথ্রো ছিলেন উপজাতি সম্প্রদায়ের পুরোহিত । নানান দেব দেবীর পূজা করতেন তিনি । মুসা কে বললেন, তোমাদের আল্লাহর কথা শুনে উপলব্ধি করতে পেরেছি, তিনি সকল দেবতার উর্ধ্বে, তিনিই সমস্ত শক্তির উৎস । এতদিন আমি ভুলপথে চালিত হয়েছি । যে সব দেবতাকে পূজা অর্চণা করেছি তারা কেউই আল্লাহর সমকক্ষ নন । আমি তার ইবাদত করতে চাই ।
মুসা ইহুদিদের মধ্যে থেকে সৎ ন্যায়বান জ্ঞানী মানুষদের বিচারক হিসাবে নিযুক্ত করলেন ।
এই সময় মুসা একদিন গভীর রাতে আল্লাহর দৈববাণী শুনতে পেলেন মুসা; আমি আমার এক দূতকে তোমাদের কাছে পাঠাব । তোমরা সকলে তাঁকে অনুসরণ করবে । কিন্তু আমার আর্শীবাদে তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না । তুমি বীরদর্পে এগিয়ে যাবে । পথে অন্য কোন দেবতার মূর্তি বিগ্রহ মন্দিরে দেখলেই তা ধ্বংস করবে । আর সর্বত্র আমার উপদেশ প্রচার করবে । যারা মূর্তি পূজা করবে তারা আমার শত্রু, তুমি তাদের ধ্বংস করবে ।
পরদিন মুসা ইহুদিদের সকলকে ডেকে বললেন তোমরা সকলে আগামী দুদিন শুদ্ধ পবিত্রভাবে থাকবে । তৃতীয় দিন দেবদূতের আর্বিভাব হবে । তখন  আমরা তাঁকে অনুসরণ করব ।
দুদিন কেটে গেল । তৃতীয় দিন ভোর থেকেই ঘন মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল । তারই সাথে ঘন ঘন বিদ্যুতের চমক,বজ্রের নিঘোর্ষ । হঠাৎ ঘন মেঘপুন্জ্ঞের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল এক তীব্র আলোকছটা । তার আলোয় সব অন্ধকার কেটে গেল । দেখা গেল এক টুকরা ভাসমান মেঘ আকাশ থেকে নেমে এল সিনাই পর্বতের মাথায় । এক মেঘ থেকে সাদা ধোঁয়ার কুন্ডুলি বার হয়ে পাহাড়ের সমস্ত চূড়াকে আচ্ছন্ন করে ফেলল ।
এমন সময় সেই মেঘপুন্জ্ঞ থেকে অলৌকিক কন্ঠস্বর ভেসে এল, মুসা, তুমি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এস । পাহাড়ের চূড়ায় উঠতেই মুসা শুনতে পেলেন আল্লাহর কন্ঠস্বর, হে আমার প্রিয় ভক্ত,আমি তোমার মাধ্যমে সমস্ত ইহুদিদের দশটি নিয়ম জানাতে চাই । শুধুমাত্র  আমাকে মানলেই চলবে না । এই দশটি নিয়ম তোমাদের সকলকে মেনে চলতে হবে ।
আল্লাহ তখন মুসার কানে কানে দশটি নির্দেশ দিলেন । এদের বলে টেন কম্যান্ডমেন্টস ।
মুসাকে আরো কিছু নির্দেশ দিয়ে আল্লাহর অদৃশ্য কন্ঠস্বর বাতাসে মিলিয়ে গেল । ঝরে গেল সেই আলোকরশ্মি মেঘপুন্জ্ঞ । সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এল ।
নিয়ম দশটি নিম্নরূপঃ
এক- আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইশ্বর নেই । তোমরা আল্লাহ ছাড়া অপর কোন দেবতার ইবাদত করবে না ।
দুই-আল্লাহকে শুধুমাত্র উপাস্য হিসাবে মান্য করলেই হবে না ।তাঁর প্রতিটি নির্দেশ আদেশ মেনে চলতে হবে ।
তিন-সপ্তাহের ছয় দিন কাজ করবে । সপ্তম দিন কোন কাজ করবে না  । এই দিন স্যাবাথ বা পবিত্র বিশ্রামের দিন ।
চার-পিতামাতাকে ভক্তি করবে, শ্রদ্ধা করবে, তাঁদের প্রতি পালনীয় কর্তব্য অবশ্যই পালন করবে।
পাঁচ-কোন মানুষকে হত্যা করো না ।
ছয়-কোন নারী বা পুরুষ কখনোই ব্যভিচার করবে না ।
সাত-অপরের দ্রব্য অপহরণ করবে না ।
আট-মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে না ।
নয়-অন্য জিনিসের প্রতি কোন লোভ করবে না, বা যাতে অন্যের অধিকার আছে তা গ্রহণ করবে না ।
দশ-উপাসনাস্থল বেদী নির্মাণ করে পশুবলি দিতে হবে ।
পাথর স্থাপন করা হল পাহাড়ের গায়ে । যাতে ইহুদিদের ভবিষৎ বংশধররা জানতে পারে ইশ্বরের আদেশের কথা ।
এইবার মুসা ইশ্বরেরর ধ্যান করবার জন্য পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেলেন । দীর্ঘ চল্লিশ দিন ধরে গভীর সাধনায় মগ্ন হয়ে রইলেন মুসা ।
এদিকে মুসা অনুপস্থিতিতে সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়ল । সকলে এসে ধরল মুসার ভাই
হারুণকে সে ভুলে গেল টেন কম্যান্ডমেন্টস্-এর নির্দেশ । সে একটি সোনার বাছুর তৈরি করে বলল, এই বাছুরটিকেই আল্লাহর প্রতীক বলে পূজা কর । তারপর একে বলি দিয়ে পূজা শেষ করব ।
সকলে বাছুর পূজার আনন্দে মেতে উঠল । ইহুদিদের এই মূর্তিপূজা দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন আল্লাহ । তিনি মুসাকে বললেন, ওদের এই গর্হিত কাজের জন্য আমি সকলকে ধ্বংস করব । সৃষ্টি করব নতুন এক জাতি ।
মুসা বুঝতে পারলেন আল্লাহ ইহুদিদের অন্যায় আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছেন । তিনি নতজানু হয়ে বসে বললেন, হে প্রভু, তুমি তোমার সন্তানদের এই অপরাধ মার্জনা কর ।
মুসার কথায় শান্ত হলেন আল্লাহ । তিনি তাঁর উপদেশ-নির্দেশ লেখা আরো দুটি পাথর দিলেন । মুসা সেই পাথর দুটি নিয়ে পাহাড় থেকে নিচে নামতেই দেখতে পেলেন সোনার বাছুরের মূর্তিকে ঘিরে ইহুদিরা আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছে । ইহুদিদের এই অসংযমী ধর্মবিরুদ্ধ আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন মুসা । তাই তিনি ক্রুদ্ধ স্বরে গর্জন করে উঠলেন , তোমরা এই নাচ ও পূজা উৎসব বন্ধ কর। ইহুদিরা কোনদিন মুসার এই ক্রুদ্ধ মূর্তি দেখেনি । তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল । মুসা বললেন, তোমরা যারা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করে আমার সঙ্গী হতে চাও তারা আমার ডানদিকে এসে দাঁড়াও । যারা আল্লাহর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করতে না চাও তারা সকলে বাঁ দিকে যাও ।
ইহুদিরা সকলেই মুসার ডানদিকে এসে দাঁড়াল । মুসা গম্ভীর কন্ঠে বললেন, তোমরা যে অন্যায় করেছ তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে ।
মুসা বললেন, প্রত্যেক পরিবারের একজন তরবারি নিয়ে এগিয়ে এস । সকলে তরবারি নিয়ে আসতেই মুসা বললেন, এই তরবারী দিয়ে তোমাদের যে কোন একজন ভাই, বন্ধু কিম্বা প্রিয়জনকে হত্যা কর । এ আমার নির্দেশ নয় , আল্লাহর আদেশ ।
সকলেই নতমস্তকে সেই আদেশ মেনে নিল । মুসা আর ইহুদিদের সাথে একত্রে বাস করতেন না । তিনি আলাদা তাবুতে থাকতেন । দিনরাত আল্লাহর ধ্যানেই মগ্ন হয়ে থাকতেন । মাঝে শুধু আল্লাহর নির্দেশগুলি প্রচার করতেন। দশটি অনুশাসন ছাড়াও এগুলি ছিল স্বতন্ত্র নির্দেশ ।
এক- বিদেশীদের স্বজাতির মানুষদের মতই ভালবাসবে ।
দুই- কেনাবেচার সময় ব্যবসায়ীরা যেন ওজনের কারচুপি না করে সঠিক দাম নেয় ।
তিন- অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক করা চলবে না ।
চার – মূর্তিপূজা, জাদুবিদ্যা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ।
আল্লাহর নির্দেশে সকলে প্যালেস্তাইনের যাত্রার প্রস্তুত হল । তিন দিন চলবার পর তারা এসে পড়ল ক্যানান নগরের প্রান্তে । এখানেই শিবির স্থাপন করা হল ।
মুসা ইহুদিদের মধ্যে থেকে বারো জন অভিজ্ঞ মানুষকে পাঠালেন প্যালেস্তাইনে । তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তর পরিদর্শন করে এসে জানাল প্যালেস্তাইনের দক্ষিণ দিকটাই সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল।
মুসা বললেন, আমরা প্যালেস্তাইনের দক্ষিণেই বসতি স্থাপন করব, তোমরা সকলে এগিয়ে চল ।
প্যালেস্তাইনের সীমান্ত প্রদেশে তখন বাস করত আমালোকিত ও কানানিত নামে দুটি উপজাতি । এই দুই উপজাতি বহুদিন ধরেই প্যালেস্তাইনে বাস করছিল । দুই উপজাতির মানুষেরা এক সঙ্গে ইহুদিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল । আচমকা এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না ইহুদিরা । তারা আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে গেল হর্মা নামে এক নির্জন প্রান্তরে ।
মুসা বুঝতে পারলেন প্যালেস্তাইনে প্রবেশ করতে গেলে অন্য পথ দিয়ে প্রবেশ করতে হবে । তারা এসে পড়লেন ক্যানানিত রাজ্যের প্রান্তে । অপরিচিত ইহুদিদের দেখেই ক্যানানিতে রাজা তাদের আক্রমণ করলেন । এইবার আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল ইহুদিরা । মুসার বুদ্ধি-কৌশলে তারা পরাজিত হল ।
সকলকে উপদেশ দিয়ে তিনি প্রার্থনায় বসলেন । বুঝতে পারলেন তাঁর সময় শেষ হয়েছে । দীর্ঘ ১২০ বছর ধরে পৃথিবীর কত কিছুই তো প্রত্যক্ষ করলেন । গত চল্লিশ বছর মেষপালক যেমন তার মেষের চালকে চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়, তিনি সমগ্র ইহুদি জাতিকে মিশর থেকে নিয়ে এসেছেন প্যালেস্তাইনের প্রান্তরে । জীবনে কোনদিন সুখভোগ করেননি । বিলাসিতা করেননি । ধর্মের পথে সৎ সরল জীবন যাপন করেছেন । প্রতিমুহূর্তে নিপীড়িত ইহুদি জাতির প্রতি নিজের অন্তরের অকুন্ঠ ভালবাসা প্রকাশ করেছেন । তাদের নানান বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন । এতদিনের তাঁর সব কাজ শেষ হল । ‍


উইলিয়ম শেকস্ পীয়র(১৫৬৪-১৬১৬)

বিশ্বের ইতিহাসে উইলিয়ম শেকস্ পীয়র এক বিস্ময় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার যার সৃষ্টি সম্বন্ধে এত বেশি আলোচনা হয়েছে, তাঁর অর্ধেকও অন্যদের নিয়ে হয়েছে কিনা সন্দেহ অথচ তাঁর জীবনকাহিনী সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানা যায় না বললেই চলে
ইংল্যাণ্ডের ইয়র্কশায়ারের অন্তর্গত এভন নদীর তীরে স্ট্রীটফোর্ড শহরে এক দরিদ্র পরিবারে উইলিয়ম শেকস্ পীয়র জন্মগ্রহণ করেন স্থানীয় চার্চের তথ্য থেকে যা জানা যায় তাতে অনুমান তিনি সম্ভবত ১৫৬৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৩ শে এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন
তাঁর পিতা জন, উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের মা ছিলেন আর্ডেন পরিবারের সন্তানউইলিয়ম শেকস্ পীয়র তাঁর As you like it নাটকে মায়ের নামকে অমর করে রেখেছেন
আঠারো বছর বয়সে উইলিয়ম শেকস্ পীয়র বিবাহ করলেন তাঁর চেয়ে ৮ বছরের বড় এ্যানি হাতওয়েকে বিবাহের কয়েক মাসের মধ্যে এ্যানি এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় তার নাম রাখা হয় সুসানা এর দুবছর পর দুটি যমজ সন্তানের জন্ম হয় ছেলে হ্যামলেট মাত্র ১ বছর বেঁচে ছিল
শোনা যায় সংসার নির্বাহের জন্য তাঁকে নানান কাজকর্ম করতে হত একবার ক্ষুধার জ্বালায় স্যার টমাসের একটি হরিণকে হত্যা করেন গ্রেফতারি পরোয়ানা এড়াতে তিনি পালিয়ে আসেন লন্ডনে কিন্তু এই কাহিনী কতদূর সত্য সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়ে যায় তবে যে কারণেই হোক তিনি স্ট্রীটফোর্ড ত্যাগ করে লন্ডন শহরে আসেন
উইলিয়ম শেকস্ পীয়রসম্পূর্ণ অপরিচিত শহরে কাজের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে পেশাদারী রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন
নাট্যজগতের সাথে এই প্রত্যক্ষ পরিচয়ই তাঁর অন্তরের সুপ্ত প্রতিভার বীজকে ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত করে তোলে
নাট্য সম্পাদনার কাজ করতে করতেই উইলিয়ম শেকস্ পীয়র অনুভব করলেন দর্শকের মনোরঞ্জনের উপযোগী ভাল নাটকের একান্তই অভাব সম্ভবত মঞ্চের প্রয়োজনেই উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের নাটক লেখার সূত্রপাতঠিক কখন তা অনুমান করা কঠিন তবে সুদীর্ঘ গবেষণার পর প্রাথমিকভাবে একটি তালিকা প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছে, তা থেকে অনুমান করা হয় যে তাঁর নাটক রচনার সূত্রপাত ১৫৯১ থেকে ১৫৯২ সাল এই সময় তিনি রচনা করেন তাঁর ঐতিহাসিক নাটক হেনরি V1- এর তিন খন্ড নাটক রচনার ক্ষেত্রে এগুলি যে তাঁর হাতেখড়ি তা সহজেই অনুমান করা যায় কারণ এতে উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের প্রতিভার সামান্যতম পরিচয় নেই এর পরের বছর লেখা নাটক রিচার্ড থ্রি অনেকাংশে উন্নত
১৫৯২ সালে ইংল্যাণ্ডে ভয়াবহ প্লেগ রোগ দেখা দিয়েছিল তখন প্লেগের অর্থ নিশ্চিত মৃত্যু দলে দলে মানুষ শহর ছেড়ে পালাতে আরম্ভ করল অনিবার্যভাবে রঙ্গশালাও বন্ধ হয়ে গেল নাটক লিখবার তাগিদ নেই; উইলিয়ম শেকস্ পীয়র রচনা করলেন তাঁর দুটি কাব্য, ভেনাস ও অ্যাডোনিস এবং দি রেপ অফ্ লুক্রি এই দুটি দীর্ঘ কবিতাই তিনি সাদমটনের আর্লকে উৎসর্গ করেন
কবি নাট্যকার হিসেবে উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের খ্যাতি ক্রমশই চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাদের দলভুক্ত হবার জন্য তাঁর কাছে আমন্ত্রণ আসছিল তিনি লর্ড চেম্বারলিনের নাট্যগোষ্ঠীতে যোগ দিলেন (১৫৯৪)এই সময় থেকে উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের হাত থেকে বের হতে থাকে এক একটি অবিস্মরণীয় নাটক-টেমিং অব দি সু, রোমিও জুলিয়েট, মার্চেন্টআব ভেনিস, হেনরি ফোর, জুলিয়াস সিজার, ওথেলো, হ্যামলেট তাঁর শেষ নাটক রচনা করেন ১৬১৩ সালে  হেনরি এইট
একদিন যিনি তস্করের মত স্ট্রীটফোর্ড ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন, সেখানেই বিরাট এক সম্পত্তি কিনলেন ইতিপূর্বে লন্ডন শহরেও একটি বাড়ি কিনেছিলেন সম্ভবত ১৬১০ সাল পর্যন্ত এই বাড়িতেই বাস করেছিলেন উইলিয়ম শেকস্ পীয়র এরপর তিনি অবসর জীবন যাপন করবার জন্য চিরদিনের জন্য লন্ডন শহরের কলকোলাহল প্রিয় রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করে চলে যান স্ট্রীটফোর্ড একটি মাত্র নাটক ছাড়া এই পর্বে আর কিছুই লেখেননি ছয় বছর পর ১৬১৬ সালের ২৩ শে এপ্রিল (দিনটি ছিল তাঁর বায়ান্নতম জন্মদিন) তাঁর মৃত্যু হল আগের দিন একটি নিমন্ত্রিত বাড়িতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে মদ্য পান করেন শীতের রাতে পথেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন আর সুস্থ হয়ে ওঠেনি উইলিয়ম শেকস্ পীয়র জন্মদিনই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিলেন তিনি





উইলিয়ম শেকস্ পীয়র এর বাড়ি
উইলিয়ম শেকস্ পীয়র এর বাড়ি

অথচ সবচেয়ে বিস্ময়ের, উইলিয়ম শেকস্ পীয়র তাঁর নাটকের প্রায় প্রতিটি কাহিনী ধার করেছেন তিনি উত্তোরণ ঘটিয়েছেন এক অসাধারণত্বে ক্ষুদ্র দীঘির মধ্যে এনেছেন সমুদ্রের বিশালতা
শুধু নাটক নয়, কবি হিসেবেও তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে অন্যতমতাঁর প্রতিটি কবিতাই এক অপূর্ব কাব্যদ্যুতিতে উজ্জ্বল দুটি কাব্য এবং ১৫৪টি সনেট তিনি রচনা করেছেন উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের প্রথম কাব্য ভেনিস ও অ্যাডোনিস কিশোর অ্যাডোনিসের সৌন্দর্যে মুগ্ধ ভেনাস তার যৌবনে রক্তের স্পন্দন সে সমস্ত মন প্রাণ সত্ত্বা দিয়ে পেতে চায় অ্যাডোনিসকে পূর্ণ করতে চায় তার দেহমনের আকাঙ্খা কিন্তু পুরুষ কি শুধুই নারীর দেহের মধ্যে পরিপূর্ণ তৃপ্তি পেতে পারে? সে যেতে চায় বন্য বরাহ শিকার করতে চমকে ওঠে ভেনাস মনের মধ্যে জেগে ওঠে শঙ্কা যদি কোন বিপদ  হয় তার প্রিয়তমের, বলে ওঠে-
বরাহ… সে যখন ক্রুদ্ধ হয়তার দুই চোখ জ্বলে ওঠে জোনাকির মতযেখানেই সে যাক তার দীর্ঘ নাসিকায়সৃষ্টি করে কবর….যদি সে তোমাকে কাছে পায়…উৎপাদিত তৃণের মতইউপড়ে আনবে তোমার সৌন্দর্য
তবুও শিউরে যায় অ্যাডোনিস দুর্ভাগ্য তার, বন্য বরাহের হিংস্র আক্রমণে ছিন্ন হয় তার দেহ হাহাকার করে ওঠে ভেনাস প্রিয়তমের মৃত্যুর বেদনায় সমস্ত অন্তর রক্তাক্ত হয়ে ওঠে
রচনার কাল অনুসারে উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের নাটকগুলিকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা যায় প্রথম ভাগের বিস্তার ১৫৮৮ থেকে ১৫৯৫ সাল পর্যন্ত এই পর্বের উল্লেখযোগ্য নাটক রিচার্ড থ্রি, কমেডি অব এররস, টেমিং অফ দি শ্রু, রোমিও জুলিয়েট
১৫৯৬ থেকে ১৬০৮ এই সময়ে রচিত হয়েছে তাঁর শ্রেষ্ঠ চারখানি ট্রাজেডি-হ্যামলেট, ওথেলো, কিং লিয়ার, ম্যাকবেথ শেষ পর্বে যে পাঁচখানি নাটক রচনা করেন তার মধ্যে দুটি অসমাপ্ত, তিনখানি সমাপ্ত এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দি টেম্পেস্ট
উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের এই নাটকগুলির মধ্যে রয়েছে কমেডি, ঐতিহাসিক নাটক, ট্রাজেডি, রোমাঞ্চ উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের উল্লেখযোগ্য কমেডি হল লাভস লেবার লস্ট, দি টু জেন্টলম্যান অফ ভেরোনা, দি টেমিং অফ দি শ্রু, কমেডি অফ এররস, এ মিড সামার নাইটস ড্রিম, মার্চেন্ট অফ ভেনিস, ম্যাচ অ্যাডো অ্যাবাউট নাথিং টুয়েফথ নাইট, অ্যাজ ইউ লাইক ইট
এর মধ্যে মাত্র কয়েকটিকে বাদ দিলে সমস্ত নাটকগুলিই এক অসাধারণ সৌন্দর্যে উজ্জ্বল প্রতিটি চরিত্রই জীবন্ত প্রাণবন্ত সজীবতায় ভরপুর
উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের বিখ্যাত তিনটি কমেডির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কমেডি হল,দি মার্চেন্ট অফ ভেনিস (The Merchant of Venice) উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের শ্রেষ্ঠ তিনটি কমেডি হল, অ্যাড ইউলাইক ইট, টুয়েলফথ নাইট, ম্যাচ এ্যাডো এ্যাবাউট নাথিং এই কমেডিগুলির মধ্যে মানব জীবন এক অসামান্য সৌন্দর্যে প্রস্ফুটিত হয়ে আছে হাসি কান্না, আনন্দ, সুখ দুঃখ মজার এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ ঘটেছে এই নাটকগুলির মধ্যে নাটকের সেই সমস্ত পাত্র-পাত্রী যারা সকল অবস্থার সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে, অন্যকে ভালবেসেছে, তারাই একমাত্র জীবনে সুখী হতে পেরেছে এই কমেডির নায়িকারা সকলেই আদর্শ চরিত্রের অন্যের প্রতি তারা সহৃদয় পরের জন্য তারা দ্বিধাহীন চিত্তে নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দেয়  একদিকে তারা করুণাময়ী, অন্যদিকে তারা বুদ্ধিমতী, উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের কমেডিতে নারী চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্বের কাছে পুরুষেরা ম্লান হয়ে যায়
ঐতিহাসিক নাটক-ইতিহাসের প্রতি উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের ছিল গভীল আগ্রহএকদিকে ইংল্যান্ডের ইতিহাস অন্যদিকে গ্রীক ও রোমান ইতিহাসের ঘটনা থেকেই তিনি তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলিকে অসাধারণ পর্যায়ে উন্নীত করেছেঐতিহাসিক নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য রিচার্ড থ্রি, হেনরি ফোর, জুলিয়াস সীজার, এ্যান্টোনি ও ক্লিওপেট্রা হেনরি ফোর নাটকের এক আশ্চর্য চরিত্র ফলস্টাফ, রাজবিদূষক, সে অফুরন্ত প্রাণরসের উৎস তাঁর চরিত্রের নানান দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের মনকে কেড়ে নেয় এমন আশ্চর্য চরিত্র বিশ্বসাহিত্যে বিরল
জুলিয়াস সীজার উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের আরেকটি বিখ্যাত নাটক এই নাটকের মূখ্য চরিত্র সীজার, ব্রুটাস এবং অ্যান্টোনি রোমের নেতা জুলিয়াস সীজার যুদ্ধ জয় করে দেশে ফিরেছেন চারদিকে উৎসব সীজারও উৎসবে যোগ দিতে চলেছেন সাথে বন্ধু অ্যান্টোনি হঠাৎ পথের মাঝে এক দৈবজ্ঞ এগিয়ে এসে সীজারকে বলে, আগামী ১৫ই মার্চ আপনার সতর্ক থাকবার দিন
সীজার দৈবজ্ঞের কথার গুরুত্ব দেন না কিন্তু দেশের একদল অভিজাত মানুষ তাঁর এই খ্যাতি ও গৌরবে ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে তারা সীজারের প্রিয় বন্ধু ব্রুটাসকে উত্তেজিত করতে থাকে সীজারের এই অপ্রতিহত ক্ষমতা যেমন করেই হোক খুন করতেই হবে না হলে একদিন সীজার সকলকে ক্রীতদাসে পরিণত করবে
কিন্তু ব্রুটাস কোন ষড়যন্ত্রে যোগ দিতে চাইছিলেন না কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীর দল নানাভাবে ব্রুটাসকে প্ররোচিত করতে থাকে মানসিক দিক থেকে দুর্বল ব্রুটস শেষ পর্যন্ত অসহায়ের মত ষড়যন্ত্রকারীদের ইচ্ছার কাছেই আত্মসমর্পণ করেন
১৫ই মার্চ সেনেটের অধিবেশনের দিন সকল সদস্যরা সেই দিন সেনেটে উপস্থিত থাকবে কিন্তু আগের রাতে বারংবার দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকেন সীজারের স্ত্রী ক্যালপুনিয়া তার নিষেধ সত্ত্বেও বীর সীজার সেনেটে গেলে সুযোগ বুজে বিদ্রোহীর দল একের পর এক ছোরা সীজারের দেহে বিদ্ধ করে শেষ আঘাত করে ব্রুটাসপ্রিয়তম বন্ধুকে বিশ্বাসঘাতকতা করতে দেখে আর্তনাদ করে ওঠে সীজার, ব্রুটাস তুমিও!
সীজারের মৃত্যুতে উল্লাসে ফেটে পড়ে ষড়যন্ত্রকারীর দল শুধু একজন প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে, সে অ্যান্টোনি প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়িয়ে জনসাধারণের কাছে সীজারকে হত্যার কারণ বিশ্লেষণ করে ব্রুটাস তার বক্তৃতায় মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে জনগণ তারা ব্রুটাসের জয়ধ্বনি করে ভুলে যায় সীজারেরর কথাব্রুটাস চলে যেতেই বক্তৃতা শুরু করে অ্যান্টোনি সে সুকৌশলে সীজারের প্রতি জনগণের ভালবাসা জাগিয়ে তোলে তাদের কাছে প্রমাণ করে সীজার একজন মহান মানুষ, তাকে অন্যায়ভাবে ব্রুটাস ও অন্যরা হত্যা করেছে
এমন সময় তুর্কীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ওথেলোকে পাঠানো হল সাইপ্রাসে তাঁর অনুগামী হল ডেসডিমোনা, বেসিও, ইয়াগো ও তার বৌ এমিলিয়া
যুদ্ধে জয়ী হয় ওথেলো তাঁর সম্মানে আনন্দ উৎসব হয় রাত গভীর হতেই নগর রক্ষার ভার বেসিওর ওপর দিয়ে ডেসডিমোনার শয়নকক্ষে যায় ওথেলো ইয়াগো এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল বেসিওকে মদ খাইয়ে মিথ্যা গণ্ডগোল সৃষ্টি করেতারই জন্যে তাকে কর্মচ্যুত করে ওথেলো দুঃখে অনুশোচনায় ভেঙে পড়ে বেসিওইয়াগো তাকে বলে ডেসডিমোনার কাছে গিয়ে অনুরোধ করতে স্ত্রীর কথা ওথেলো কখনোই ফেলতে পারবে না
বেসিও যায় ডেসডিমোনার কাছে গোপনে ওথেলো ইয়াগোকে ডেকে বলে দুজনের মধ্যে গোপন প্রণয় আছে ওথেলোর মনের মধ্যে সন্দেহের বীজ জেগে ওঠেওথেলো ডেসডিমোনাকে একটি মন্ত্রপূত রুমাল দিয়েছিল ডেসডিমোনা কখনো সেই রুমালটি নিজের হাতছাড়া করত না একদিন ডেসডিমোনার কাছ থেকে রুমালটি হারিয়ে গিয়েছিল তা কুঁড়িয়ে নিয়ে এমিলিয়াকে দিল ইয়াগো দিল বেসিও কে ডেসডিমোনার কাছে রুমাল না দেখে ওথেলোর সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়তারই সাথে ওথেলোর মনকে আরো বিষাক্ত করে তোলে ইয়াগো ক্রোধ আত্মহারা হয়ে ওথেলো ঘুমন্ত ডেসডিমোনাকে গলা টিপে হত্যা করে তারপরই আসল সত্য প্রকাশ পায় ইয়াগোকে বন্দী করা হয় আর ওথেলো নিজের বুকে ছুরিবিদ্ধ করে আত্মহত্যা করে বীর ওথেলোর এই মৃত্যু আমাদের সমস্ত অন্তরকে ব্যথিত করে তোলে
উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের আর একখানি বিখ্যাত নাটক ম্যাকবেথ উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের ট্রাজেডির সব নায়িকার মধ্যেই যে মহিয়সী রুপের প্রকাশ দেখতে পাই, লেডি ম্যাকবেথের মধ্যে তা পাই না ম্যাকবেথ সাহসী বীর কিন্তু মানসিক দিক থেকে কিছুটা দুর্বল, তাই তার স্ত্রীর কথায় সে চালিত হয় লেডি ম্যাকবেথের প্ররোচনায় সে খুন করে তার রাজাকে তারপর সিংহাসন অধিকার করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের মৃত্যুবরণ করতে হয় লেডি ম্যাকবেথের চরিত্রের মধ্যে পাপের পূর্ণ প্রকাশ ঘটলেও তার চরিত্রের অসাধারণ দৃঢ়তা, অদম্য তেজ, দৃপ্ত ভঙ্গি,অরাজের মনোবল, আমাদের মুগ্ধ করে তার প্রতিটি কাজের পেছনে ছিল এক উচ্চাশা কোন নীচতার স্পর্শ সেই সেখানে উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে তাঁর হ্যামলেট নাটকে এক আশ্চর্য চরিত্র এই হ্যামলেট সে মানুষের চির রহস্যের, কখনো তার উন্মাদের ভাব, কখনো উচ্ছ্বাস, কখনো আবেগ,এরই সাথে ঘৃণা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, প্রতিহিংসা তার চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব যুগ যুগ ধরে পাঠককে বিভ্রান্ত করে তোলে তাই বোধহয় নাট্যকার বান্যাডশ কৌতুক করে বলেছিলেন ডেসমার্কের ঐ পাগল ছেলেটা কি করে তাঁর ভোঁতা তলোয়ার দিয়ে পৃথিবীটাকে জয় করে ফেলল, ভাবতে ভাবতে আমার দাড়ি পেকে গেল
ডেনমার্কের যুবরাজ হ্যামলেট সবেমাত্র পিতার মৃত্যু হয়েছে মা তারই কাকাকে বিবাহ করেছে পিতার মৃত্যুতে শোকাহত হ্যামলেট একদিন রাতে তার কয়েকজন অনুচর দূর্গপ্রকার পাহারা দিতে দিতে দেখতে পায় হ্যামলেটের পিতার প্রেতমূর্তিহ্যামলেট পিতার সেই প্রেতমূর্তির সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে সেই প্রেতমূর্তি তাকে বলে, বাগানে ঘুমাবার সময় তারই ভাই (হ্যামলেটের কাকা) কানের মধ্যে বিষ ঢেলে দেয় আর তাতেই তার মৃত্যু হয় হ্যামলেট যেন এই মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়হ্যামলেট বুঝতে পারে তার পিতাকে হত্যা করা হয়েছে সে উন্মাদের মত হয়ে ওঠে তার প্রিয়তমা ওফেলিয়ার সাথে অবধি এমন আচরণ করে যা তার স্বভাববিরুদ্ধ নিজের অজান্তে পিতা পলোনিয়াসকে হত্যা করে মানসিক আঘাতে বিপর্যস্ত ওফেলিয়া আত্মহত্যা করে আর হ্যামলেট আত্মদ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে সে শুধু তার পিতার হত্যাকারীকেই হত্যা করতে চায় না, সে চায় রাজপ্রসাদের সব পাপ কলুষতা দূর করতে ষড়যন্ত্রের জাল চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে হ্যামলেটের কাকা তাকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করতে চায় কিন্তু সেই বিষ পান করে মারা যান হ্যামলেটের মা ক্রুদ্ধ হ্যামলেট তরবারির আঘাতে হত্যা করে কাকাকে কিন্তু নিজেও বিষাক্ত ছুরির ক্ষতে নিহত হয়
হ্যামলেটের এই মৃত্যু এক বেদনাময় গভীর অনুভুতির স্তরে নিয়ে যায়
শেষ লেখা- উইলিয়ম শেকস্ পীয়রের শেষ পর্যায়ের লেখাগুলির ট্রাজেডি বা কমেডি থেকে ভিন্নধর্মী রোমাঞ্চ, মেলোড্রামা, বিচিত্র কল্পনার এক সংমিশ্রণ ঘটেছে এই সব নাটকে সিমবেলিন, উইন্টার্সটেল, টেমপেস্ট উল্লেখযোগ্য

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget