ইসা (আঃ)


ইসা (আঃ)
(খ্রীঃ পূর্ব ৬-৩০)

বিবি মরিয়ম নাছেরাহ নামক একটি শহরের অধিবাসিনী ছিলেন। নাছেরাহ শহরটি বাইতুল মুকাদ্দাসের অদূরেই অবস্থিত ছিল। বিবি মরিয়ম পিতা মাতার মানত পূর্ণ করার জন্য বাইতুল মুকাদ্দাসের খেদমতে নিযুক্ত ছিলেন বাল্যকাল থেকেই। অতিশয় সুশীলা এবং ধর্মানুরাগিনী ছিলেন। তাঁর পিতার নাম ছিল ইমরান এবং নবী জাকারিয়া (আঃ) এর শ্যালিকা বিবি হান্না তাঁর জননী ছিলেন। একদিন বিবি মরিয়ম নামাজ পড়ছিলেন, হঠাৎ ফেরেশতা জিব্রাঈল অবতীর্ণ হলেন। তিনি বললেন, তোমার প্রতি সালাম, তুমি আল্লাহর অনুগ্রহ প্রাপ্তা। আল্লাহ তোমার সাথে রয়েছেন ।
বিবি মরিয়ম এই অপ্রত্যাশিত পূর্ব সম্বোধনে ভীত চকিতা হলেন। ভাবতে লাগলেন-কে আসল, কিসের সালাম। হযরত জিব্রাঈল বললেন-আমি অল্লাহর ফেরেশতা জিব্রাঈল। তুমি ভীত হইও না; তুমি পবিত্র সন্তান লাভ করবে। এই সুসংবাদ তোমাকে দিতে এসেছি।
বালিকা ভীত হলেন এবং বললেন-তা কেমন করে হবে? আমি যে কুমারী। আমি স্বামীর সঙ্গ লাভ করিনি।
ফেরেশতা বললেন, “আল্লাহর কুদরতেই এটি হবে। তাঁর কাছে এটি কঠিন কাজ নয়।”
এই বলে ফেরেশতা অন্তর্নিহিত হলেন। ছয়মাস পূর্বে হযরত জাকারিয়া (আঃ)-এর স্ত্রী গর্ভবতী হয়েছেন-এখন আবার কুমারী মরিয়ম আল্লাহর কুদরতে গর্ভবতী হলেন।
বিবি মরিয়ম যদিও আল্লাহর কুদরতে সন্তান সম্ভবা হলেন, কিন্তু দেশের লোকেরা তা মেনে নিবে কেন? কুমারী নারীর এভাবে গর্ভবতী হওয়ার ফলে সবাই তাকে বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে বের করে দিলেন-এমন কি তাকে স্বগ্রাম ছেড়ে যেতে হলো্। সঙ্গী সহায়হীন অবস্থায় গর্ভবতী মরিয়ম একটি নির্জন প্রান্তরে সন্তান প্রসব করলেন।
বিপদাপন্ন মরিয়ম কোন আশ্রয় খুঁজে না পেয়ে একটি শহরের দ্বারপ্রান্তে আস্তাবলের একটি পতিত প্রাঙ্গণের খেজুর গাছের নীচে আশ্রয় নিলেন। হায়-যিনি পৃথিবীর মহা সম্মানিত নবী, তিনি সেই নগন্য স্থানে ভূমিষ্ঠ হলেন। যে মহানবীর ধর্মানুসরণকারিরা আজ পৃথিবীময় বিস্তৃত, শক্তি এবং সম্মানে যারা পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে রয়েছে; তাদের নবী ভূমিষ্ঠ হলেন একটি আস্তাবলের অব্যবহার্য আঙ্গিনায়। দরিদ্রতম পিতা-মাতার সন্তানও এই সময় একটু শয্যালাভ করে থাকে, একটু শান্তির উপকরণ পায়, কিন্তু মরিয়মের সন্তান শোয়াবার জন্য আস্তাবলের ঘরটুকু ছাড়া আর কিছুই ভাগ্যে হলো না। আটদিন বয়সে সন্তানের ত্বক ছেদনা করা হলো। তাঁর নামকরণ হলো ইছা। ইনি মছিহ নামে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। হযরত মুছা (আঃ)- এর শরীয়ত অনুসারে বাদশাহ কিংবা পয়গাম্বর তাঁর পদে বহাল হবার অনুষ্ঠানে, তৈল লেপন করার নিয়ম ছিল। এছাড়া তৌরিত কেতাবে হযরত ইছা (আঃ)- এর নাম মছিহ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করলে একজোড়া ঘুঘু জাতীয় পাখি উৎসর্গ করার নিয়ম হযরত মুছা (আঃ)-এর শরীয়তের বিধান ছিল। মরিয়ম সূচী-স্নাতা হওয়ার পর সন্তান সাথে নিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসে গেলেন এবং সেখানে গিয়ে পাখীর মানত পালন করলেন।
এই সময় একদল অগ্নিপূজক হযরত ইছা (আঃ)-কে খুঁজে ফিরছিল। তারা জ্যোতিষী ছিল। নক্ষত্র দেখে তারা ‘হযরত ইছা এর জন্ম হয়েছে’ এটি জানতে পেরেছিল। হিরুইস বাদশাহ এটি শুনে ভয় পেলেন এবং সেই অনুসন্ধানকারী দলের কাছে গোপনে বললেন যে, তারা যেন সেই বালকের সন্ধান করে কোথায় আছে তা বের করে। অগ্নিপূজকরা খুঁজতে খুঁজতে বিবি মরিয়মের কাছে পৌছালো ও সেই ক্ষুদ্র শিশুকে সেজদা করল এবং সেখানে মানত ইত্যাদি সম্পন্ন করল। রাতে তারা স্বপ্নে দেখল, তাদেরকে হিরুইসের কাছে ফিরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা হিরুইস তার জীবনের শত্রু। মরিয়ম এরুপ স্বপ্ন দেললেন যে, সম্রাট এই সন্তানের শত্রু, সে তাকে হত্যা করতে চায়। সে যেন শিশুকে নিয়ে মিশরে চলে যায়। জ্যোতিষীরা সম্রাটের কাছে আর ফিরে গেল না। এতে বাদশাহ ভয়ানক রাগ হলো। সে হুকুম করল যে, বায়তুল্লাহর এবং এর আশেপাশের সকল বস্তির সন্তানদেরকে যেন হত্যা করে ফেলা হয়।
ইতিপূর্বে মরিয়ম তাঁর সন্তান নিয়ে মিশরে রওনা হয়ে গিয়েছিলেন। হিরুইস যতদিন জীবিত ছিল, ততদিন সন্তান নিয়ে তিনি মিশরেই অবস্থান করলেন।
হিরুইসের মৃত্যুর সংবাদ শুনার পর তিনি নিজ দেশ নাছেরায় চলে আসলেন।
সন্তান দিন দিন বাড়তে লাগল। বয়স বাড়বার সাথে সাথে ইছার মধ্যে প্রখর জ্ঞান এবং তীক্ষ্ম মেধা শক্তির পরিচয় ফুটে উঠল। আল্লাহর বিশেষ একটি অনুগৃহ যে, তাঁর উপর রয়েছে, দিন দিন তা প্রকাশ পেতে শুরু করল। ইছার মাতা ইছা সহ প্রতি বৎসর ঈদের উৎসবে ইরুসালেমে যোগদান করতেন। ইছার ১২ বৎসর বয়সে ইরুসালেমে বড় বড় জ্ঞানী এবং পন্ডিতবর্গের সাথে ধর্ম বিষয়ে হযরত ইছা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পূর্ণতা লাভ করতে লাগলেন। ত্রিশ বৎসব বয়সে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে ‘অহী’ লাভ করেন এবং নবীরুপে ধর্মপ্রচার করতে শুরু করলেন।
হযরত ইয়াহইয়া বিবি মরিয়মের খালাত ভাই হতেন। তিনি ইয়ারদন নদীর তীরে লোকদেরকে ধর্মোপদেশ দান করতেন। হযরত ইছা (আঃ) সেখানে গিহয়ে ওয়াজ করতে শুরু করেন। -অহী আসা শুরু করার পর থেকে ইনজীল কেতাব অবতীর্ণ হতে থাকে। তিনি তাঁর নবুয়্যতের প্রমাণ স্বরুপ বহু অলৌকিক কার্যাবলী দেখাতে শুরু করেন। মাটি দিয়ে পাখী তৈরি করে উড়িয়ে দেয়া, অন্ধকে দৃষ্টিদান, বোবাকে বাক্শক্তি দান, কুষ্ঠকে আরোগ্য করা, পানির উপরে হাটা ইত্যাদি তাঁর মো’জেজা ছিল।
তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির বলে, বহু রোগী আরোগ্য লাভ করে। বহু লোক ধর্মজ্ঞান লাভ করে। সর্বপ্রথম যারা হযরত ইছা (আঃ) –এর উপর যারা ঈমান এনেছিলেন, সাথে থেকে সাহায্য করেছিলেন তাদেরকে ‘হাওয়ারী’ বলা হতো। তাঁরা সর্বদা হযরত ইছা (আঃ) এর সাথে থাকতেন। হযরত ইছা (আঃ) যখন নবী হন, সেকালে ইয়াহুদী ধর্মগুরুরা অতিশয় শিথিল হয়ে পড়েছিলেন। তাদের মধ্যে প্রকৃত ধর্মানুভূতির পরিবর্তে ভন্ডামী প্রবেশ করেছিল। তাদের মধ্যে কেবল ধর্মের বাহ্যিক আবরণ বাকী ছিল। হযরত ইছা (আঃ) এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি তাঁর ওয়াজ বক্তৃতায় ইয়াহুদী ধর্মগুরুদের কঠোর সমালোচনা করতেন। এতে সেই সকল বাহ্যাবরণ বিশিষ্ট ইয়াহুদী ধর্মপ্রচারকরা হযরত ইছা (আঃ)-এর ঘোর শত্রুতে পরিণত হন। কিন্তু হযরত ইছা (আঃ)—এর বাণী ছিল আল্লাহরই বাণী। তা এমনই হৃদয়গ্রাহী হতো যে, যে শুনত তার হৃদয়ই তাতে আকৃষ্ট হতো। বিদ্বেষপরায়ণ ইয়াহুদী পুরোহিতরা কোন কথায় হযরত ইছা (আঃ)-কে ধরতে পারতেন না। তারা হযরত ইছা (আঃ) –কে নানা ছুতা-নাতায় দোষী সাব্যস্ত করবার চেষ্টায় লিপ্ত হলেন।
হযরত ইছা (আঃ) আল্লাহর অত্যাধিক প্রেমে অভিভূক্ত হয়ে আল্লাহকে পিতা বলেছিলেন। এরুপ আরো দুই একটি দৃষ্টান্তমূলক বাক্য নিয়ে হিংসাপরায়ণ ইয়াহুদী আলেমগণ নানা কথা সৃষ্টি করলেন। এভাবে তারা হযরত ইছা (আঃ)-কে ধর্মদ্রোহী কাফের বলে ফতোয়া দিলেন। তাদের শরীয়তে মৃত্যুই সেই সকল অপরাধ এর একমাত্র সাজা। দেশে তখন রুমীয়দের রাজত্ব ছিল। তখনকার দিনে রাজা ছাড়া আর কারো মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার অধিকার ছিল না। সুতরাং তারা সম্রাটের কানে হযরত ইছা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করতে শুরু করলেন।
হযরত ইছা (আঃ) তাঁর বক্তৃতার অধিকাংশ সময় আসমানী বাদশাহের কথা উল্লেখ করতেন। এতে শত্রুদের একটি সুযোগ জুটে গেল। তারা আসমানী বাদশাহীর ব্যাখ্যা একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হযরত ইছা (আঃ)-এর প্রতি রাজদ্রোহীর অভিযোগ সৃষ্টি করল। গোপনভাবে তাকে ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল।
অদৃষ্টের এমনি বিড়ম্বনা, যে হাওয়োরী দল ইছা (আঃ)-এর সঙ্গী এবং বিশ্বস্ত বন্ধুরুপে বিরাজ করতেন, তারাই এখন গুপ্তচর হলেন। সেই হাোয়াদীদের মধ্যে একজনের নাম ছিল ইয়াহুদ। শত্রুদের কাছ থেকে তিন টকার ঘুষ গ্রহণ করে হযরত ইছা (আঃ) –কে রুমীয় সৈন্যদের হাতে ধরিয়ে দিল।
হাওয়ারীয়দের মধ্যে পিতর ছিল একজন ঘনিষ্ঠ এবং প্রধান সঙ্গী, রাজদ্রোহের অপরাধ থেকে বাঁচবার জন্য তিনি সম্রাটের দরবারে নিজ পরিচয় গোপন এবং হযরত ইছা (আঃ)-এর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই বলে প্রকাশ করলেন। হযরত ইছা (আঃ) ধৃত হলেন এবং রাজবিচারে তিনি মৃত্যুদণ্ড লাভ করলেন। সে সময়ের মৃত্যুদণ্ডে এখনকার মত গলায় ফাঁসী দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। ছলীবের সাহায্যে তখন মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো।
ছলীবের আকৃতি হলো এই – একটি লম্বা কাঠের উপরের অংশে আর একখানি কাঠ আড়াআড়িভবে জুড়ে দেয়া হতো। তাতে অপরাধীকে এমনিভাবে ঝুলিয়ে দেয়া হতো যে, অপরাধীর পৃষ্ঠদেশ কাষ্ঠদ্বয়ের সংযুক্তি স্থলের উপর রক্ষিত হতো। আড়া কাঠের উভয় দিকে দুই হাত বিস্তারিত করে দিয়ে তাতে পেরেক মেরে দেয়া হতো। কারো হাটুতে ও পেরেক ফুড়ে কাঠ-সলগ্ন করে দেয়া হতো। এই অবস্থায় ঝুলে থেকে ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও যন্ত্রণায় ছটফট করে মরে যেত। হযরত ইছা (আঃ) –কে ও ছলীবে বিদ্ধ করে রাখা হলো। পরদিন ইয়াহুদীদের উৎসবের দিনে কোনো অপরাধীর ছলীবে ঝুলন্ত থাকা তাদের ধর্মমতে বিধেয় ছিল না। হযরত ইছা (আঃ)-কে দুপুরের দিকে ক্রুশে বিদ্ধ করা হয়েছিল। পায়ে কাটা বিদ্ধ করা হচ্ছিল না। তবুও তিনি সেই যাতনায়ই মুষড়িয়ে পড়লেন এবং চেতনা হারালেন; তিনি শরীরের দিক দিয়েও কৃশকায় ছিলেন। ঈদের দিনের কারণে যখন সন্ধ্যার দিকে তাঁকে ক্রুশ থেকে খসান হলো, তখন তাঁকে মৃত বলেই ধারণা করা হলো। তাঁকে গোরস্থানে পাঠিয়ে দেয়া হলো এবং দাফন করা হলো। কোন সহৃদয় ব্যক্তি তাঁকে কবর থেকে উঠিয়ে এনেছিলেন। পরে তিনি চেতনা লাভ করলেন। অতঃপর তিনি নিরুদ্দেশ হন। তিনি কোথায় কিভাবে আত্মগোপন করেন তার সঠিক তত্ত্ব জানা যায়নি। কোরআন শরীফে তাঁর সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে যে, তাঁকে হত্যা করা হয়নি। তিনি ক্রুশে প্রাণ দান করেন নি। বরং মৃত্যুর মতোই ধারণা করা হয়েছিল, পরে আল্লাহ তাঁকে পৃথিবী থেকে তুলে নিলেন। এর ৫ শত বৎসর পরে হযরত মোহাম্মদ মোস্তাফা (দঃ) এই পৃথিবীতে সংবাদ দিয়েছেন।

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.

[blogger]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget