পাহাড় সমুদ্রের ঐকতান অন্ধ্রপ্রদেশের "ভিমুনিপত্তনম" (Bheemunipatnam City in India)

 ভিমুনিপত্তনমের সাগর কিনারে
 
সৈকত ছাড়িয়ে নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে বেরিয়েছিল যে জেলে, অনেক দূরে। অনুজ্জ্বল তার নৌকোয় রাখা লণ্ঠনের আলোকবিন্দু। সমুদ্রতটে লোকজন কমতে শুরু করেছে। যে কয়েকটি খাবারের দোকান খোলা ছিল, তাদের চুল্লিতে এখন জলের ঝাপটা। বিচের ধারে রাখা গাড়িগুলোও এক এক করে ছেড়ে যাচ্ছে। শুধু জলে নামার নিষেধ উপেক্ষা করে এই আবছায়াতেও সমুদ্রস্নানে মত্ত কিছু মানুষ। আর হাওয়ায় ফিরে ফিরে বেড়াচ্ছে সমুদ্রশাসনের গর্জন। এমন আদুরে মেজাজ ও মায়াবি পরিবেশের হাতছানি উপেক্ষা করে হোটেলে পৌঁছেই অভিজ্ঞতা লেখার জন্য কলম ধরলাম।
 
এই কলমের হাত ধরেই তো বিশাখাপত্তনমকে চিনেছিলাম! ছিমছাম শহর, ঝকঝকে রাস্তাঘাট। এ বার তোমার খুব প্রিয় শহর ছাড়িয়ে আর একটু দূরে এসেছি, অন্ধ্রপ্রদেশেরই ভিমুনিপত্তনমে। আদর করে যাকে ডাকা হয়, ‘ভিমিলি’। কিন্তু কেন? আমার মতো একই সঙ্গে পাহাড়-সমুদ্র যাদের পছন্দ, ভিমিলি তাদের জন্যই। সেই সঙ্গে প্রাচীন ঐতিহ্য, দেশজ সংস্কৃতি, স্থানীয় খাবার আলাদা করেছে জায়গাটাকে। বিশাখাপত্তনম থেকে কম-বেশি গাড়িতে সওয়া ঘণ্টার সফর। বিচ রোড ধরে রুশিকোণ্ডা পেরিয়ে সমুদ্রকে ডান দিকে রেখে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে শুরু হয়েছিল পথ চলা। কোথাও সমুদ্র আলতো করে পাড় ছুঁয়ে গেল, আবার কোথাও বা ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়েই। ঠিক যেন কবিতার মতো। চোখের তৃপ্তি। মনের আরাম। নেই অকারণ কোলাহল। খুব বেশি হোটেল-রিসর্টের আতিশয্য নেই। কিন্তু যা আছে, সব ক’টি থেকেই সমুদ্র চোখে পড়বে। দুপুরে এমন একটি হোটেলে ব্যাকপ্যাক রেখেই গোধূলি আলোয় ভিমিলিকে খুঁজতে বার হই। অক্টোবর থেকে মার্চ এখানে আসার মনোরম সময়।
 
হানিমুনের জন্যও জায়গাটির কদর আছে বেশ। শান্ত, নির্জন “ভিমিলিকে” ঘিরে রেখেছে নারকেল গাছের সারি। লাল মাটির ঢিবি, অনন্ত নীল জলরাশি আর সোনালি বালির সমুদ্র সৈকত নিয়ে ভিমিলি সত্যি নয়নাভিরাম। ভোরের ভিমিলি আরও রোম্যান্টিক। সাদা কুয়াশার চাদরে সে রহস্যময়ী। বিচে নামার মুখেই বুদ্ধদেবের মুখের বিরাট প্রতিকৃতি আর সাগর কিনারে পাথরের বুকে অপূর্বসুন্দর মৎস্যকন্যার ভাস্কর্য, এখানেই ভিমিলি আলাদা। তবে বিশাখাপত্তনমের রামকৃষ্ণ বিচ বা রুশিকোণ্ডার মতো বেশি পাথুরে নয় কিন্তু! ঢাল বেয়ে নামা সোনালি বালির বিচ সারা দিন রোদ মাখে আর নীল ঢেউয়ে লুটোপুটি খায়। আর ভাটায় শ্যাওলা পাথরের খাঁজে জলকেলি ছোট ছোট মাছের...এর সাক্ষী হয়েই রোদ্দুর মেখে নোনাবালির তীর ধরে হারিয়ে গিয়েছিলাম শঙ্খচিলের মতোই। আর কী জানো! এখানে বিচের রাস্তার ধারে বসার অনেক জায়গা, সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সমুদ্র দেখে কাটানো যায়। আরও এগোলে দূরে সবুজ পাহাড়ি টিলা ও বাঁ দিকে অর্ধচন্দ্রাকার সৈকত দেখে মনে হয়েছিল, প্রকৃতি যেন আরামকেদারায় শুয়ে! জানা গেল, ওটা আসলে মোহনা। গোস্থানি নদী এখানে এসে সাগরে মুখ লুকিয়েছে।
 
 ভিমুনিপত্তনম মূর্তি
 
ভিমুনিপত্তনমকে যতটা ছোট ভেবেছিলাম, ততটা সে নয়! ভাবতে পারেন, এই জনপদে দেশের দ্বিতীয় প্রাচীন মিউনিসিপ্যালিটি রয়েছে। ঔপনিবেশিক আভিজাত্যের সঙ্গে পৌরাণিক গৌরবগাথা “ভিমিলিকে” দিয়েছে অনন্যতা। লোকশ্রুতি, “ভিমিলির” নাম হয়েছে পাণ্ডব ভ্রাতা ভীমের নামানুসারে। সপ্তদশ শতকে ভিমিলি ছিল ডাচ্ বন্দরনগরী। তার কিছু চিহ্ন রয়ে গিয়েছে এখনও। আছে অনুচ্চ লাইটহাউস, তবে পরিত্যক্ত। বিচ পেরিয়ে রাস্তার ও পারে রয়েছে সমাধি। সেখানে ব্রিটিশ, ডাচ্ , ফরাসি ও স্থানীয়রা সমাধিস্থ। এগুলো ঘুরে অতীতের স্বাদ নিলাম কিছুটা।
তুমি বলতে, যে জায়গায় যাই, তাকে পুরোপুরি না জানলে বেড়ানোর সার্থকতা কোথায়? কতটা চিনলাম জানি না, কিন্তু কেমন এক মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি। স্থানীয় খাবারের স্বাদের মায়াতেও... আনাজ পোলাও, নারকেলের চাটনি মেশানো মেদু বড়া, পকোড়াও ছিল খাবারের পদে।
শেষ রাত ছিল পূর্ণিমার। বারান্দার সামনে ১৮০ ডিগ্রিতে বর্ণময় ক্যানভাস। বাতাসে আদুরে ভিজে হাওয়া। যত দূর চোখ যায়, শুধুই পান্নারঙা জলের বিস্তৃতি। ধীরে ধীরে রং বদলায়। এ প্রাপ্তি অনেক। নিজের জায়গায় এসেও বারে বারে ফিরে তাকায় “ভিমিলি”। আসলে কিছু বেড়ানোর গন্ধ গায়ে লেগে থাকে সারা জীবন।
যাঁদের পায়ের তলায় সর্ষে, ভিমিলিকে মধ্যমণি রেখেই তাঁরা আরও কয়েকটি জায়গা ঘুরতে পারবেন। বিশাখাপত্তনম থেকে ভিমিলি যাওয়ার পথেই কৈলাসগিরি, রুশিকোণ্ডা ও রামা নাইডু ফিল্ম স্টুডিয়ো পড়ে। আবার অন্য পথে বৌদ্ধ নিদর্শন বাভিকোণ্ডা, থোতলাকোণ্ডাও খুব একটা দূরে নয়। সময় ও ইচ্ছে হলে এর সঙ্গে জুড়ে ফেলা যায় আরাকু ভ্যালিও। আর এক দিন ইয়ারাডার সমুদ্র সৈকতকে সফরের তালিকায় রাখতে পারলে, তা মনে থেকে যাবে চিরদিন।

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.

[blogger]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget