জুলিয়াস সিজার

জুলিয়াস সিজার[খ্রিঃ পূঃ ১০০-৪৪]

কপালের লিখনই তাই। প্রথম, সিজার প্রথমই হবে। রোমে যদি দ্বিতীয় হতে হয় তবে সিজার বরং গ্রামে যাবে- যেখানে সে প্রথম হয়ে থাকবে। তবুও প্রথমই হতে হবে তাকে। সেটাই তার ভাগ্যলিপি। সিজারের ভাগ্যই ঠিক করে রেখেছিল, গ্রাম নয়, রোমেই প্রথম হবে সিজার। সে নেবে ‘ পিতৃভূমির পিতা’ এই গর্বিত উপাধি। এসবই যেন ছিল পূর্বনিদিষ্ট। সিজার যদি আরও একটু কম উচ্চাঙ্ক্ষী হতো, তাহলে ইউরোপের ইতিহাস, তার সভ্যতার ধারা হয়তো বইতো অন্য খাতে।
সিজার এমন এক  ব্যক্তি, যার দাবি ঈশ্বরের সংঙ্গে আত্মীয়তার সূত্রে বদ্ধ তিনি। আর সিজার যখন ক্ষমতার মধ্যগগনে, তখন তার ঘোষণা, আত্মীয় নয়, তিনিই স্বয়ং ঈশ্বর। সিজার হল সেই ব্যক্তি যিনি রোমান সাম্রাজ্যের সীমানাকে উত্তর ও পশ্চিমে বিস্তৃত করেছেন, মানব ইতিহাসে এমন এক চিহ্ন রেখে গেছেন যা মুছবে না কোন সময়ই। একদিন যে পথে সিজারের বাহিনী রোম থেকে বেরিয়েছিল বিশ্বজয়ে, একদিন পৌত্তলিক প্রতিভা সাম্রাজ্যের যে ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল-তারই ওপর গড়ে উঠেছিল খ্রিস্ট্রীয় ইউরোপের বিরাট পরিকাঠামো। সিজারের সেই পথ ধরেই কয়েক শতাব্দী পরে খ্রিস্ট্রীয় মিশনারিরা বেরিয়েছিল খ্রিস্ট ধর্মের অনুশাসনে পৃথিবী জয়ে।
১০২ খ্রিঃ পূর্বাব্দে সেই মাসে- যে মাসটার নাম তাঁরই প্রতি সম্মান জানাতে চিহ্নিত হয়েছিল জুলাই নামে, সেই ১০২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের জুলাইয়ে তাঁর জন্মের কয়েক প্রজন্ম আগেও একটা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। কিন্তু তা গতি ছিল এলোমেলো। কখনও এদিকে। কখনও ওদিকে। ভূমধ্য সাগরের তীরে সভ্যতার কেন্দ্র হবার জন্য ছিল সে সংগ্রাম। গ্রীকরা তাদের যুদ্ধ জয়ের মধ্য দিয়ে দর্শন, সাহিত্য এবং শিল্পে বিস্ময়কর অগ্রগতির মধ্য দিয়ে মানব ইতিহাসে রেখে গেছে তাদের সদম্ভ উপস্থিতির চিহ্ন একার্থে জিয়রা উন্নীত হয়েছিল বণিক জাতি হিসেবে- শাসিত হয়েছিল বণিক ও ধনীদের দ্বারা আর সব সময় অন্তরে পুষে রেখেছিল ক্ষমতা দখলের বাসনা। আর সেই সময়ই গর্ভলক্ষণহীন ইতালির মাটিতে নয়া উপনিবেশ গড়ছিল যারা তারা গ্রীক পর্যটক এবং বণিকদের কাছে থেকে দ্রুত শিখে নিচ্ছিল অনেক কিছু এবং ক্রমেই ধনী প্রতিবেশীদের ভয়ের কারণ হয়ে উঠছিল।
সে সময় রোমকে কেন্দ্র  করে বলিয়ান হয়ে উঠলি যে রোমিওরা, তাদের সঙ্গে কাথেজিওদের শুরু হয়ে গিয়েছিল ক্ষমতা দখল ও শ্রেষ্ঠত্বের এক তীব্র লড়াই । সে লড়াই ছিল অস্তিত্ব রক্ষারও লড়াই। কার্থেজিওদের শাসন বিস্তৃত ছিল স্পেন এবং গলের দক্ষিণ উপকূল ভাগ ধরে। রোমানরা তাদের দেখতে রীতিমত ভয়ের চোখে। কার্থেজিও নেতা হানিবলের সঙ্গে লড়াইয়ে তরা বিপর্যস্তও হয়। তাদের পরাজিত করেই হানিবলের বাহিনী অতিক্রম করে আল্পস পর্বতমালাও, বিধ্বস্ত করে ইতালিকে। এই ব্যর্থতা, এই বিপর্যয় সত্ত্বেও রোমানরা কিন্তু জাতি হিসেবে নিশ্চিহ্ন হয়ে হয়ে যায়নি। সে সময় রোম যে আশ্চর্য অনুষ্ঠানের কৌশল নিয়েছিল তারই কাছে হেরে যেটুকু জয় করেছিল সেটুকুই খুইয়ে  বসে হানিবল। পরিণতিতে পূর্ণ প্রতিশোধই নেয় রোম। শুধু অধিকার নয়, কার্থেজের সাধারণ মানুষের নৈতিক বল ছিল খুবই কম। তারা ছিল মুনাফা তৈরির যন্ত্রের একটি অংশ মাত্র। গ্রীসের শাসকরা অধীনস্থ রাজ্যগুলিকে হেয় করে রেখে করেছিল বিরাট ভুল। কিন্তু রোম যেমন অন্যর কাছ থেকে চিন্তাধারা গ্রহণের ব্যাপারে অকৃপণ ছিল তেমনি গ্রীক দেবতাদের মেনে নিয়েও তারা সেই দেবতাদের দেয় নতুন নতুন নাম। সেই সঙ্গে এই ভূমির অভিবাসনকারী অথবা তার অধিকৃত অঞ্চলের লোকজনের সঙ্গে ও সে এমন ব্যবহার করত যাতে তারা স্বেচ্ছায় এর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেত।
রোম বরাবরই শিক্ষা নিত ইতিহাস থেকে। সে জানত, একটি বিজয়ী শক্তি যখন জোর করে বিজিতের ওপর সবকিছু চাপিয়ে দেয়, তখন সঙ্কটের সময় একটা বড় ফাটল দেখা দিতে বাধ্য। অন্যের নীতি অনুসরণের মধ্যে দিয়ে রোম খুঁজে পেত তার শক্তি। ঔপনিবেশিকদের চাতুর্যে, নাগরিকত্ব দানের মধ্য দিয়ে,সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি রূপায়ণের মধ্য দিয়ে রোম তার প্রতিপক্ষের সামনে খাড়া করে শক্ত প্রতিরোধের প্রাচীর।
জুলিয়াস সিজারের জীবন ও কর্মধারা আলোচনার সময় ইতিহাসের ঐ প্রেক্ষাপটটি মনে রাখা দরকার। এই প্রেক্ষাপট জানা নাথাকলে, জুলিয়াস সিজার কিভাবে তার সমকালের বহু গুণাবলী এবং দোষ ত্রুটি ও অন্যায়ের বিরল নজির হয়ে উঠেছিলেন তা ঠিক বোঝা যাবে না।
রোমের যে সম্ভ্রান্ত পরিবারে সিজারের জন্ম, সেই পরিবারটি নিজেদের মনে করত স্বর্গের দেবতা ভেনাস এবং ইলিয়াসের উত্তরপুরুষ ‍হিসেবে। এই দেবতার সঙ্গে সংযোগের এই ধারণাটাই স্ফীত করেছিল সিজারের গর্বকে এবং হয়তো এই গর্বই পরবর্তীকালে তাকে ভাবতে শিখেছিল, তার সমস্ত শক্তি সত্যই অতিমানবিক।
যুবক জুলিয়াসে যুক্ত হয়েছিলেন তার মহার জেনারেল ম্যারিয়াসের দলে। এই দল যখন ক্ষমতা দখল করে তখন পুরস্কার হিসেবেই রোমানদের প্রধার দেবতা জুপিটারের অর্চক পদে নিযুক্ত হন জুলিয়াস। কিন্তু এই সাফল্য ছিল ক্ষণস্থায়ী। এর কিছুদিন পরেই সপ্তমবারের জন্য কনশান পদে নির্বাচিত ম্যারিয়াসের জীবনাবসান হয়। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পদ এবং সম্পত্তি দুই হারিয়ে রোম ছাড়তে হয় ম্যারিয়াসের অনুগামীদের।
বিরোধী দল নেতা সুল্লা বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন রোমে। সুল্লা সিজারকে ক্ষমা করতে রাজি ছিলেন একটি মাত্র শর্তে।  সে শর্ত, ঘণিত গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে যুক্ত তার যুবতী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে হবে। সিজার রাজি হলেন না। এই রাজি না হওয়ার জন্য সিজারকে বরণ করতে হয় ভয়ানক বিপদকে। রোম আর তার পক্ষে তখন নিরাপদ জায়গা নয়। সিজার তাই তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে ঘুরতে থাকেন পূর্বদিকে। এই সময়েই যুদ্ধ সম্পর্কে প্রথম শিক্ষাটি নেন তিনি, সেই শিক্ষাই পরবর্তীকালে তাঁকে বিরাট ভূমিকা নিতে সাহায্য করেছিল। রাজনীতির দাক্ষিণ্য আবার যখন তাঁর ওপর বর্ধিত হল, তখন তিনি রোম ফিরে এলেন আইন শিক্ষার জন্য। সেটাই হল তাঁর নায়ক হবার সোপান।
রোডমে বিখ্যাত অ্যাপেলেনিয়াস মোলোনের কাছে বাগ্মীতা শিখতে গিয়ে সিজার কিছু অসৎস আমোদ প্রমোদের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। সেনাজীবনের নানা অসুবিধা আর  শিক্ষণজীবনের নিষ্ঠার বাইরে এই জীবন বেশি করে টানতে থাকল সিজারকে। নাগরিক জীবনের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম জুয়ায় কেটে যেত তাঁর দিনের অনেকটা সময়। ধারের পর ধারে তিনি যেন আকণ্ঠ ডুবে যেতে থাকলেন। শোনা যায় এক সময় তার ঋণের পরিমাণ দাড়ায় দুলক্ষ পাউন্ড। এই সময়ই স্পেনের গভর্নর পদে নিয়োগ করা হয় সিজারকে। কিন্তু তাঁর মহাজনেরা তাঁর স্পেনে খুশি যাও। এই সময় সিজারের ত্রাতা হিসেবে দেখা দিলেন রোমের বিখ্যাত ধনী ক্র্যাসাস। সিজারের হয়ে তিনি সব ঋণ মিটিয়ে দিলেন। কথা রইল, সিজার যখন আবার আর্থিক দিকে সচ্ছল হবে এবং সামরিক অভিযানের মাধ্যমে নিজের সুনামকে বাড়াবেন সেই সময় মিটিয়ে দেবেন ক্র্যাসাসের সব টাকা।
অসাধারণ দক্ষতায় সিজার এবার ধনী ক্র্যাসাসের সঙ্গে বরি পম্পের বিরোধ মিটিয়ে আবার তাদের বন্ধু করে তললেন। এই পম্পের সামরিক দক্ষতা তাঁকে রোমের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি করে তুলেছিল। ৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, এই তিনজন মিলে যে শাসক চক্র গড়ে তুললেন তাই হল রোমের প্রথম ত্রয়ীশাসক চক্র। সিজার কন্সাশ হলেও সামরিক বিভাগের পরিবর্তে পেলেন সড়ক  ও বনাঞ্চল রক্ষার দায়িত্ব।
সিজার এবার এশিয়া মাইনরের দিকে যান। সেখানে তিনি পম্পের এক পুরনো সহযোগীকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে জয়ের ফলে সিজার নিজের অবস্থা আরও জোরদার করেন। এই অভিযানের সময় সিজার উচ্চারণ করেন সেই বিখ্যাত উক্তি-ভিনি, ভিসি, ভিসি-এলাম, দেখলাম, জয় করলাম।
ইতালিতে ফেরার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার সিজারকে বেরতে হল বিদ্রোহ দমনে। এবার তিনি ভূমধ্যসাগর পার হয়ে আফ্রিকা অভিযানে গেলেন।
শেষ পর্যন্ত তিনি ইতালিতে ফিরে এলেন। এলেন গ্রামে প্রথম হতে  নয়। রোমে প্রথম হতে। তিনি প্রথমে দশ বছরের জন্য, পরে আমৃত্যু নিজেকে একনায়ক হিসাবে ঘোষণা করলেন। স্বল্পকাল ক্ষমতায় থারার সূত্রেই সিজার সুবিচারক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেলেন এবং তাঁর এই আত্মশ্লাষাই ডেকে আনল তাঁর মৃত্যুকে। তবুও ওই সময়েই আল্পসের গুলি পেল বন্ধুত্ব, ক্যালেন্ডার সংস্কার হল, স্বাধীন মানুষ পেল আরও স্বাধীনতার সুনিশ্চিত আশ্বাস, এবং জনস্বার্থে হাত দেওয়া হল বড় বড় কাজে।
সেনেট হাউসে পম্পের মূর্তির পাদদেশে ঘন ঘন অশনি সম্পাতে আলোকিত ঝড়ো হওয়ার মধ্যে ঘাতকের ছুরিকাঘাতে নিভে যায় তাঁ জীবনদীপ। বলা হয় যারা তাঁকে খুন করে তাঁর মধ্যে শত্রুর চেয়ে তাঁর মিত্রই ছিলবেশি। আমরা জানি তাঁর শেষ কথাটি ছিল হায় ক্রুটাস, তুমিও!
সিজার সেই মৃত্যুর মুখে দেখেছিলেন তার  ঘনিষ্ঠজনরাই  তাঁকে নিঃসঙ্গ করেন। বুঝলেন তাঁর সাফল্যই পরাজিত করল তাঁকে। সিজারই রোমের দৃষ্টিকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে উত্তর ইউরোপের দিকে প্রসারিত করেন। বিচ্ছিন্ন জাতিগুলিকে তিনিই পারদর্শিতার চিহ্ন রেখে গেছেন তাঁর যুদ্ধ বিবরণীতে আর গড়ে দিয়ে গেছেন তার ভাগ্নে অগস্টাসের জন্য সাম্রাজ্য গড়ার রাস্তা। সিজার চরিত্রকে অল্প কয়েকটি কথার মধ্যে তুলে ধরেছেন লর্ড টুহউসমুরি এইভাবে-
“এই পৃথিবীর গুরুভার কাঁধে নিয়েও তিনি লঘুপদে চলার ক্ষমতা হারাননি। যুদ্ধ কিংবা প্রশাসন কখনই তাঁকে করে তোলেনি এক সঙ্কীর্ণ বিশেষজ্ঞ। তাঁর সংস্কৃতি তাঁর  সমকালের যে কোর মানুষের চেয়ে ছিল বিস্তৃত।তিনি ভালবাসতেন শিল্প এবং কবিতা, সঙ্গীত এবং দর্শনকে। জীবনের কঠিনতম মুহূর্তেও তিনি এরই মধ্যে নিমগ্ন হতেন। তাঁর মধ্যে ছিল এক সক্রিয় মানুষের বাস্তবতাবোধ, শিল্পের অনুভূতি, সৃজনশীল স্বপ্নাল ব্যক্তির কল্পনাপ্রবণতা। এতগুলি গুণের সমাহার, আমি মনে করি, আর কোথাও ঘটেনি।”

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.

[blogger]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget