পিথাগোরাস

পিথাগোরাস[৫৮০-৫০০]

গণিতশাস্ত্রের ইতিহাসে যিনি আদিপুরুষ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছেন তাঁর নাম পিথাগোরাস। তিনি ছিলেন একাধারে গণিতজ্ঞ চিন্তাবিদ দার্শনিক। প্রায় আড়াই হাজার বছন আগে বর্তমান তুরস্কের পশ্চিমে ইজিয়ান সাগরের সামস  দ্বীপে পিথাগোরাসের জন্ম। এই সামস ছিল গ্রীসের ক্রোতনা দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত। ছেলেবেলা থেকেই বিদ্যা অনুরাগের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল পিথাগোরাসের। তিনি বিশ্বাস করতেন কোন একদজন শুরুর কাছে জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় না। জ্ঞানের ভান্ডার ছড়িয়ে আছে পৃথিবীব্যাপী। তাই সামস শহরে তাঁর শিক্ষা শেষ করে বার হলেন দেশভ্রমণে। সেই সময় গ্রীস দেশের বাণিজ্যতরীগুলি বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য করতে যেত। এমনি একটি জাহাজে করে তিনি রওনা হলেন মিশরে। প্রাচীন গ্রীসের মত প্রাচীন মিশরও ছিল জ্ঞান- বিজ্ঞার চর্চার কেন্দ্রভূমি। এখানে প্রধানত গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের শিক্ষালাভ করেন।
মিশরে অবস্থানের সময় পিরমিড দর্শন করে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যান। বিশাল পিরামিড নির্মাণের সময় যে গাণিতিক নিয়ম অনুসারে পাথরগুলিকে সাজান হয়েছিল তা থেকেই সম্ভবত তাঁর মনে প্রথম জ্যামিতির সম্বন্ধে চিন্তা- ভাবনা জেগে ওঠে। যদিও জ্যামিতির জনক ইউক্লিড, (আনুমানিক ৩২০-২৭৫ খ্রিস্টপূর্ব) । তিনিই প্রথম জ্যামিতির জন্য সুসংহতভাবে নির্দিষ্ট পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। এরই পরিণতি তাঁর বিখ্যাত উপপাদ্যটি সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের উপর অঙ্কিত বর্গ ওই ত্রিভুজের অপর দুই বাহুর উপর বর্গের যোগফলের সমান।
এই বিষয়ে ভিন্ন মত প্রচলিত আছে। পিথাগোরাস দেশভ্রমণ করতে করতে ভারতবর্ষে এসে উপস্থিত হন। প্রাচীন মিশরের মত প্রাচীন ভারতবর্ষও ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রভূমি। পিথাগোরাসের আবির্ভাবের অন্তত একশ বছর ভারতীয় পন্ডিত বৌধয়ন জ্যামিতি সম্বন্ধে চিন্তা- ভাবনা শুরু করেন। সম্ভবত তাঁর কোন সূত্র থেকে পিথাগোরাস এই উপপাদ্যটি রচনা করেন। কোন সূত্র থেকে তিনি এই রচনাটি করেছিলেন তা জানা না গেলেও এটি যে তার মৌলিক রচনা এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
বিবাহ ও বন্ধু নির্বাচনের সময় তিনি সংখ্যার খু্বই গুরুত্ব দিতেন। শোনা যায় কোন এক যুবরাজ তাঁর মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। বিবাহের সময় তিনি গণনা করে দেখলেন তাঁর নামের সংখ্যা ২৮৪। ‍তিনি ঘোষণা করলেন যে কন্যার নামের সংখ্যা হবে ২২০, সেই হবে তাঁর আদর্শ স্ত্রী। তবে পিথাগোরাস তাঁর নিজের বিবাহের সময় এই সংখ্যার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেননি। তিনি তাঁরই এক ছাত্রী থিয়ানোকে বিবাহ করেছিলেন। থিয়ানো শুধু তাঁর যোগ্য ছাত্রী ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন আদর্শ স্ত্রী। থিয়ানোর গর্ভে পিথাগোরাসের একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তার নাম ড্যামো । ড্যামো ছিলেন পিতার মতই পন্ডিত দার্শনিক। পিথাগোরাস সমস্ত জীবন ধরে  যা কিছু রচনা করেছিলেন তা গুপ্ত রাখবার জন্য কন্যাকে নিদের্শ দিয়ে যান। আমৃত্যু কন্যা সেই নিদের্শ পালন করেছিল।
সংগীতের সঙ্গে সংখ্যার যে নিবিড় সম্পর্কূ –অর্থাৎ সংগীতের সাথে তাল ও লয়ের যে ঐক্য –তা পিথাগোরাসেই আবিস্কার। এই প্রসঙ্গে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। তিনি একদিন রাজপথ দিয়ে হাঁটছিলেন, পথের ধারে এক কামারের দোকান। অকস্মাৎ তাঁর কানে এল হাতুড়ি ঠোকার শব্দ। একটি শব্দের সাথে আরেকটি শব্দের কোন ঐক্য খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তিনি দোকানে সব কটি হাতুড়ি ওজন করে দেখলেন – তাদের ওজন হল ৬, ৮,৯,৭, এই সংখ্যাগুলির সম্পর্ক নির্ণয় করলেন (২*৩) অর্থাৎ ৬ (২*৪)=৮  (৩*৩)=৯। এই তিনটি হাতুড়ির আওয়াজের মধ্যে মিল খুঁজে পেলেন কিন্তু চতুর্থ হাতুড়িটির ওজন ছিল সামঞ্জস্যহীন, তাই তার আওয়াজও ছিল বেসুরো।
সংগীত ও ঔষধের মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্পর্ক খুজেঁ বার করেছিলেন পিথাগোরীয়ানরা। তাঁদের মতে মানুষের দেহও বাদ্যবন্ত্রের মত নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। সংগীতের উচ্চ স্বর নিম্ন স্বরের মতই দেহ কখনো শীতন কখনো উত্তপ্ত হয়। নির্দিষ্ট সুরে যখন বাদ্যযন্ত্র বাঁধা থাকে তখনই তার থেকে সংগীতের উদ্ভর হয়। মানব দেহ যদি যন্ত্রের তারের মত চড়া পর্দায় বাঁধা হয় কিম্বা টান শিথিল হয়ে পড়ে কখন শরীরে নানান রোগের উদ্ভব হয়। স্বাস্থ্য বিষয়ে তাঁর বহু বক্তব্য আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
পিথাগোরাসই প্রথম বলেছিলেন পৃথিবীর আকার গোল। আমাদের চারপাশের গ্রহ-নক্ষত্র এই পৃথিবী আবর্তিত হচ্ছে। কোপার্নিকাস তাঁর রচনায় অপকটে পিথাগোরাসের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের মত পিথাগোরাস জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন আত্মা অমর-তার লয় নেই । মৃত্যুর পর আত্মা নতুন দেহে জন্ম নেয়। একদিন পিথাগোরাস দেখলেন একটি লোক কুকুরটিকে মারছে। যন্ত্রণায় কুকুরটি চিৎকার করছে। কুকুরটির চিৎকারে বিচলিত হয়ে পড়লেন পিথাগোরাস। তাঁর মনে হলঐ কন্ঠস্বর তাঁর মৃত বন্ধুর। মৃত্যুর পর সে কুকুর হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। গণিতে তাঁর অবদানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে হেরোক্লিটাস স্বীকার করেছেন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অন্য সকলকে তিনি অতিক্রম করে গিয়েছেন। ধর্ম  বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নির্ণয়ের প্রসঙ্গে তিনি বলতেন, বিজ্ঞানের মধ্যেই আছে সর্বশ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধতা এবং যে মানুষ এই বিশুদ্ধতাতেই নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন তিনিই শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। অ্যারিস্টটল তাঁর প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, “পিথাগোরাসই প্রথম পাটিগণিতকে বাণিজ্যিক প্রয়োজনের সীমারেখার গণ্ডি অতিক্রম করে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছিলেন। তিনি ত্রিভুজের ব্যবহার জানতেন এবং ৩, ৪, ৫ সংখ্যার সাহায্যে সমকোণী ত্রিভুজ অঙ্কন করতে জানতেন। পরবর্তীকালে এটি পিথাগোরীয় ত্রিভুজ নামে পরিচিত হয়।
জীবনকালে গ্রীস দেশে পিথাগোরাসের জনপ্রিয়তা ছিল বিরাট। তাঁর ছাত্র শিষ্য ছাড়াও দেশের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি তাঁর  পান্ডিত্যের জন্য তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা করত। ক্রমশই পিথাগোরাসের অনুগামীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাদের মধ্যে অনেকে জ্ঞানচর্চার চেয়ে রাজনীতির চর্চায় বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠে। দেশের রাজশক্তি এতে চিন্তিত হয়ে ওঠে। তাছাড়া কিছু বুদ্ধিজীবীও পিথাগোরাসের খ্যাতির জনাপ্রয়তা সম্মানে ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেছিল। তারা রাজশক্তির সাথে একত্রিত হয়ে পিথাগোরাসের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করতে আরম্ভ করল। এই প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে জনসাধারণ পিথাগোরাস্ শিক্ষাকেন্দ্র আক্রমণ করল। পিথাগোরাসের শিষ্য যারা বাধা দিতে এল তারা মারা পড়ল, অনেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল।
শিষ্যদের অনুরোধে পিথাগোরাসও পালাতে আরম্ভ করলেন। তিনি বিক্ষুব্ধদের প্রায় নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। হঠাৎ সামনে পড়ল কলাই জাতীয় এক শস্যের ক্ষেত। তিনি ইচ্ছে করলেই ক্ষেতের উপর দিয়ে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তিনি বিশ্বাস করতেন-কলাইয়েরও প্রাণ আছে। একটি জীবন্ত কলাইয়ের উপর পা দেওয়ার অর্থ একটি জীবনকে হত্যা করা। নিজের জীবর বিপন্ন জেনেও কলাইয়ের উপর পা রাখলেন না। সেই সুযোগে বিপক্ষ দলের লোকেরা এসে তাঁকে হত্যা করল। নিজের জীবন দিয়ে নিজের আদর্শকে রক্ষা করলেন পিথাগোরাস।

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.

[blogger]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget