আলেকজান্ডার দি গ্রেট

আলেকজান্ডার দি গ্রেট[৩৫৬ খ্রিষ্ট পূর্ব-৩২৩ খ্রিষ্ট পূর্ব ]

খ্রিষ্ট পূর্ব চারশো বছর আগেকার কথা। গ্রীস তখন অসংখ্য ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। এমন একটি রাষ্ট্রের অধিপতি ছিলেন ফিলিপ ।ফিলিপ ছিলেন বীর,সাহসী,রণকুশলী। সিংহাসন অধিকার করবার অল্প দিনের মধ্যেই গড়ে তুললেন সুদক্ষ এক সৈন্যবাহিনী। ফিলিপের পুত্রই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে বীর আলেকজান্ডার।খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫৬ সালের আলেকজান্ডারের জন্ম। আলেকজান্ডারের মা ছিলেন কিছুটা অস্বাভাবিক প্রকৃতির। সম্রাট ফিলিপকে কোন দিনই প্রসন্নভাবে গ্রহণ করতে পারেননি।
ছেলেবেলা থেকেই আলেকজান্ডারের দেহ ছিল সুগঠিত। বাদামী চুল,হালকা রং। সবছেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় ছিল আলেকজান্ডার শরীর থেকে সব সময় একটা অপূর্ব সুগন্ধ বার হত।সমকালীন অনেকেই এই সুগন্ধের কথা উল্লেখ করেছেন।
যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকলেও পুত্রের শিক্ষার দিকে ফিলিপের ছিল তীক্ষ্ন নজর্র। আরেকজান্ডারের প্রথম শিক্ষক ছিলেন লিওনিদোস নামে অলিম্পিয়াসের এক আত্মীয়।আলেকজান্ডার ছিলেন যেমন অশান্ত তেমনি জেদী আর একরোখা। শিশু আলেকজান্ডারকে পড়াশুনায় মনোযোগী করতে প্রচন্ড বেগ পেতে হত লিওনিদোসকে।কিন্তু তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন আলেকজান্ডার। লিওনিদোসের কাছে শিখতেন অঙ্ক, ইতিহাসের বিভিন্ন কাহিনী, অশ্বরোহণ,তীরব্দাজী।
কিশোর বয়স থেকেই তাঁর মধ্যে ফুটে উঠেছিল বীরোচিত সাহস।এই সাহসের সাথে সংমিশ্রণ ঘটেছিল তীক্ষ্ন বুদ্ধির ।একদিন একজন ব্যবসায়ী একটি ঘোড়া বিক্রি করেছিল ফিলিপের কাছে।এমন সুন্দর ঘোড়া সচরাচর দেখা যায় না। ফিলিপের লোকজন ঘোড়াটিকে মাঠে নিয়ে যেতেই হিংস্র হয়ে উঠল। যতবারই লোকেরা তার পিঠের উপরে উঠতে চেষ্টা করে,ততবারই তাদের আঘাত করে দূরে ছিটকে ফেলে দেয়। শেষ আর কেউই ঘোড়ার পিটে উঠতে সাহস পেল না। কাছেই দাড়িয়েছিলেন ফিলিপ আর আলেকজান্ডার। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন নিজের ছায়া দেখে ভয় পাচ্ছে ঘোড়াটি।তাই ঘোড়ার পাশে গিয়ে আস্তে আস্তে তার মুখটা সূর্যের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। তারপর ঘোড়াটিকে আদর করতে করতে একলাফে পিঠের উপর উঠে পড়লেন। উপস্থিত সকলেই আতস্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। যদি ঐ ঘোড়া আলেকজান্ডার আহত করে। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে এলেন আলেকজান্ডার। ঘোড়া থেকে নেমে ফিলিপের সামনে আসতেই পুত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ফিলিপ। বললেন, তোমাকে এইভাবে নতুন রাজ্য জয় করতে হবে। তোমার তুলনায় ম্যাসিডন খুবই ছোট।ফিলিপ  অনুভব করতে পারলেন তাঁর ছেলে অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। এখন শুধু প্রয়োজন প্রকৃত শিক্ষার এবং সে ভার আলেকজান্ডারের জন্মের সময়েই সমর্পণ করেছেন মহাজ্ঞানী অ্যারিস্টটলের উপর। অ্যারিস্টটল ফিলিপের আমন্ত্রনে ম্যাসিডনে এলেন।
দীর্ঘ তিন বছর ধরে অ্যারিস্টটলের কাছে শিক্ষালাভ করেছিলেন আলেকজান্ডার।পরবর্তীকালে অনেক ঐতিহাসিকের অভিমত,নিজেকে বিশ্ববিজয়ী হিসাবে গড়ে তোলার শিক্ষা আলেকজান্ডার পেয়েছিলেন অ্যারিস্টটলের কাছে।
আমৃত্যু গুরুকে গভীর সম্মান করতেন আলেকজান্ডার। তাঁর গবেষণার সমস্ত দায়িত্বভার নিজেই গ্রহণ করেছিলেন। নিজের গুরুর প্রতি সম্মান জানাতে গিয়ে আলেকজান্ডার বললেন, এই জীবনে পেয়েছি পিতার কাছে। কিন্তু সেই জীবনকে কি করে আরো সুন্দর করে তোলা যায়,সেই শিক্ষা পেয়েছি গুরুর কাছে।
আলেকজান্ডারের বয়স যখন ষোল,ফিলিপ বাইজানটাইন অভিযানে বার হলেন। পুত্রের উপর রাজ্যের সমস্ত ভার অর্পণ করলেন। ফিলিপের অনুপস্থিতিতে কিছু অধিনন্থ অঞ্চলের নেতারা বিদ্রোহ ঘোষণা করল। কিশোর আলেকজান্ডার নিচেষ্ট হয়ে বসে রইলেন না। বীরদর্পে সৈন্যবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শুধু বিদ্রোহীদের পরাজিত করলেন না, তাদের বন্দী করে নিয়ে এলেন ম্যাসিডনে।
এই যুদ্ধজয়ে অনুপ্রাণিত আলেকজান্ডার সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগিয়ে চললেন। প্রথম যে দেশ জয় করলেন, নিজের নামে সেই দেশের নাম রাখলেন আলেকজানডার পেলিস।
পিতা-পুত্রের মধ্যেকার সম্পর্ক ক্রমশই খারাপ হতে থাকে। এর পেছনে মায়ের প্ররোচনাও ছিল যথেষ্ট।আলেকজান্ডারের যখন কুড়ি বছর বয়স, ফিলিপ আততায়ীর হাতে নিহত হলেন। এর পেছনে রানী অলিম্পিয়াসেরও হাত ছিল। ফিলিপ নিহত হতেই সিংহাসন অধিকার করলেন আলেকজান্ডার।প্রথমই হত্যা করা হল নতুন রানীয় কন্যাকে,নতুন রানীকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করলেন রানী অলিম্পিয়াস।যাতে ভবিষ্যতে কেঊ তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে।আলেকজান্ডার পারস্যের রাজধানী পার্সেপেলিশ দখল করলেন। সেই সময় পার্সেপেলিশ ছিল পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ নগর।যুগ ‍যুগ ধরে পারস্য সম্রাটেরা বিভিন্ন দেশ থেকে সম্পদ আহরণ করে এখানে সঞ্চিত করে রেখেছিল।সব সম্পদ অধিকার করলেন আলেকজান্ডার।রাজপ্রাসাদের সকলকে বন্দী করা হল।দারিয়ুসের মা,স্ত্রী,দুই কন্যাকে বন্দী করে আনা হল আলেকজান্ডারের সামনে। তাঁরা সকলেই মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিল।কিন্তু আলেকজান্ডার তাদের সম্মানে মুক্তি দিয়ে প্রাসাদে ফিরিয়ে দিলেন।

পারস্য অভিযানের পর তিনি সিরিয়া অভিযান শুরু করলেন। সমুদ্র-বেষ্টিত শহর দখল করবার সময় অসাধারণ সামরিক কৌশলের পরিচয় দেন। সৈন্য পারাপার করবার জন্য সমুদ্রের উপর দীর্ঘ সেতু নিমার্ণ করলেন।সিরিয়ার সৈন্যবাহিনী ছিল খুবই শক্তিশালী। এক প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী মরণপণ সংগ্রামের পর জয়ী হলেন আলেকজান্ডার।সিরিয়া দখল করবার পর দখল করলেন প্যালেস্টাইন,তারপর মিশর। মিশরে নিজের নামে স্থাপন করলেন নতুন নগর আলেকজান্দ্রিয়া।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৮ সালের মধ্যে সমগ্র পারস্য সাম্রাজ্য তাঁর অধিকারে এল।
৩২৭ খ্রিষ্টপূর্বে আলেকজান্ডার সৈন্যবাহিনী নিয়ে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ভারতবর্ষে প্রবেশ করলেন।সেই সময় ভারতবর্ষে ছিল অসংখ্য ছোট বড় রাষ্ট্র।কারোর সাথেই কারোর সদ্ভাব ছিল না। প্রত্যেকেই পরস্পরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হত।
তক্ষশীলার রাজা অম্ভি প্রতিবেশী রাজা পুরু শক্তি খর্ব করবার জন্য আলেকজান্ডার বন্ধুত্ব চেয়ে তাঁর কাছে দূত পাঠালেন।
দীর্ঘ এক মাস চলবার পর নিহত হলেন রাজা অষ্টক। গ্রীক সৈন্যরা পূস্কলাবতী নগর দখল করে নিল।প্রতিবেশী সমস্ত রাজাই আলেকজান্ডারে বশ্যতা স্বীকার করে নিল। শুধু একজন আলেকজান্ডার বশ্যতা স্বীকার করতে অস্বীকার করলেন,তিনি রাজা পুরু।
আলেকজান্ডার সরাসরি শত্রুসৈন্যের মুখোমুখি হতে চাইলেন না।তিনি গোপনে অন্য পথ দিয়ে নদী পার হয়ে পুরুকে আক্রমণ করলেন। পুরু ও তাঁর সৈন্যবাহিনী অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করলেও আলেকজান্ডারের রণনিপুণ বাহিনীর কাছে পরাজয় বরণ করতে হল। আহত পুরু বন্দী হলেন। তাঁকে নিয়ে আসা হল আলেকজান্ডারের কাছে।তিনি শৃঙ্খলিত পুরুকে জিজ্ঞাসা করলেন,আপনি আমার কাছে কি রকম ব্যবহার আশা করেন? পুরু জবাব দিলেন, একজন রাজা অন্য রাজার সঙ্গে যে ব্যবহার আশা করেন, আমিও সেই ব্যবহার আশা করি। পুরুর বীরত্ব, তাঁর নির্ভীক উত্তর শুনে এতখানি মুগ্ধ হলেন আলেকজান্ডার, তাঁকে মুক্তিদিয়ে শুধু তাঁর জন্য রাজ্যই ফিরিয়ে দিলেন না, বন্ধুত্ব স্থাপন করে আরো কিছু অঞ্চল উপহার দিলেন।আলেকজান্ডার ইচ্ছা ছিল আরো পূর্বে মগধ আক্রমণ করবেন।কিন্তু তাঁর সৈন্যবাহিনী আর অগ্রসর হতে চাইল না।দীর্ঘ কয়েক বছর তারা মাতৃভূমি ত্যাগ করে এসেছিল।আত্মীয় বন্ধু পরিজনের বিরহ তাদের মনকে উদাসি করে তুলেছিল। এছাড়া দীর্ঘ  পথশ্রমে যুদ্ধের পর যুদ্ধে সকলেই ক্লান্ত। অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বদেশের পথে প্রত্যাবর্তন করলেন আলেকজান্ডার । দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আলেকজান্ডার এসে পৌছালেন ব্যাবিলনে। ব্যাবিলনে এসে কয়েক মাস বিশ্রাম নিয়ে স্থির করলেন আরবের কিছু অঞ্চল জয় করে উত্তর আফ্রিকা জয় করবেন। কিন্তু ২রা জুন খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন আলেকজান্ডার। এগারো দিন পর মারা গেলেন আলেকজান্ডার। তখন দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা নেমেছিল।
আলেকজান্ডার মাত্র ৩৩ বছর বেঁচেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং সেই বিশ্বব্যাপী সম্রাজের অধিশ্বর হতে। তার মনের অতিমানবীর এই ইচ্ছাকে পূর্ণ করবার জন্য তিনি তাঁর স্বলাপকালীন জীবনের অর্ধেককেই প্রায় অতিবাহিত করেছেন যুদ্ধেক্ষেত্রে। তাঁর বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য
ঐতিহাসিকরা তাঁকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতির আসনে বসিয়েছেন। তাঁক “    আলেকজান্ডার দি গ্রেট” এই নামে অভিহিত করা হয়েছে।
নিরপেক্ষ বিচারে কি আলেকজান্ডারকে শ্রেষ্ঠ মহৎ নৃপতি হিসাবে ব্যাখা দেওয়া যায়? এই প্রসঙ্গে একজন প্রখ্যাত জীবনীকার লিখেছেন,অনেকে তাঁকে মানব জীবনের যা কিছু শ্রেষ্ঠ গুণ-মহত্ত্বতা,বীরত্বের এক প্রতিভু বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি নগর স্থাপন করেছেন,অসভ্য জাতিকে সভ্য করেছেন,পথঘাট নির্মাণ করেছেন,দেশে দেশে সুম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আলেকজান্ডার সভ্যতা সংস্কৃতি সম্বন্ধে উৎসাহী ছিলেন না। নিজের খ্যাতি গৌরব প্রভুত্ব ছাড়া কোন বিষয়েই তাঁর কোন আগ্রহ ছিল না। এক পৈশাচিক উন্মাদনায় তিনি শুধু চেয়েছিলেন পৃথীবীকে পদানত করতে।তিনি যা কিছু করেছিলেন, সব কিছুই শুধুমাত্র নিজের গৌরবের জন্য, মানব কল্যাণের জন্য নয়। তিনি যে ক’টা নগর স্থাপন করেছিলেন, তার চেয়ে বেশি নগর গ্রাম জনপদকে ধ্বংস ককরেছিলেন। হাজার হাজার মানুষকে নিজের ইচ্ছা চরিতার্থতার জন্য হত্যা করেছিলেন।
সুপ্রাচীন মহান গ্রীক সভ্যতার একটি মাত্র বাণীকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন দেশে দেশে। সে বাণী ধ্বংসের আর মৃত্যূর । শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রচারে ব্যাপারে তাঁর সামান্যতম আগ্রহ ছিল না। তাঁর তৈরি করা পথে পরবর্তীকালে ব্যবসা-বাণিজ্যর প্রসার ঘটেছিল বলে অনেকে তাঁর দূরদর্শিতার প্রশংসা করেন। কিন্তু এই পথ তিনি তৈরী করেছিলেন সভ্যতাকে ধ্বংসের কাজ তরাম্বিত করতে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর নাম চিরদিন ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে সভ্যতার অগ্রদূত হিসাবে নয়-ধ্বংস,ঝঞ্বা, হত্যা ,মৃত্যুর পথপ্রদর্শক হিসাবে।

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.

[blogger]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget