মহাত্মা গান্ধীজী

মহাত্মা গান্ধীজী
[১৮৬৯-১৯৪৮]

গুজরাটের পোরবন্দরে এক মধ্যবিত্তপরিবারে মহাত্মা গান্ধীর জন্ম (১৮৬৯ সালের ২রা অক্টোবর)। বাবার নাম করমচাঁদ গান্ধী। তার কনিষ্ঠ পুত্র গান্ধী। তাঁর নাম ছিল মোহনদাস। গুজরাটি প্রথা অনুসারে পুরো নাম হল মোহনদাস গান্ধী। মায়ের নাম পুতলীবাঈ। গান্ধী ছেলেবেলায় বাবা-মায়ের সাথে পোরবন্দরে ছিলেন। সেখানকার স্থানীয় পাঠশালায় তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। যখন তাঁর সাত বছর বয়েস , বাবা রাজকোটের বিচারপতি হয়ে গেলেন। প্রথমে রাজকোটের এক পাঠশালায় এবং পরে হাই স্কুলে ভর্তি হলেন।
মাত্র তেরো বছর বয়েসে গান্ধীর বিবাহ হয়। গান্ধীর কাছে সেই সময় স্ত্রী কন্তুরীরাঈ বা কন্তুরা ছিলেন এক খেলার সাথী। কন্তুরীরাঈ ছিলেন সম্পূর্ণ নিরক্ষর, গান্ধীর আন্তরিক চেষ্টায় সামান্য পড়াশুনা শিখেছিলেন।
বিবাহের তিন বৎসরের মধ্যেই গান্ধীজির পিতা মারা গেলেন। ১৮৮৭ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্থানীয় কলেজে ভর্তি হলেন। এই সময় তাঁর বিলাতে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়বার ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে।
গান্ধীর পরিবারের সকলেই ছিলেন নিরামিষভোজী এবং রক্ষণশীল মনোভাবের। ছেলে বিলাতে গিয়ে বংশের নিয়ম-কানুন সম্পূর্ণ ভাবে ভুলে যাবে এই আশঙ্কায় কেউই তাঁকে প্রথমে যাবার অনুমতি দিতে চায় না। শেষ পর্যন্ত গান্ধীর বড় ভাই তাঁকে বিলাতে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়বার অনুমতি দিলেন। ১৮৮৮ সালে তিনি ইংল্যান্ডের পথে রওনা হলেন।
অল্প দিনের মধ্যেই তিনি নিজের অভ্যস্ত জীবন শুরু করলেন।


১৮৯১ সালে গান্ধী ব্যারিস্টারি পাস করে ভারতে ফিরে এলেন। কয়েক মাস পরিবারের সকলের সাথে রাজকোটে থাকার পর বোম্বাই গেলেন। উদ্দেশ্য ব্যারিস্টারি করা। কিন্তু চার মাসের মধ্যে অর্থ উপার্জনে তেমন কোন সুবিধা করতে পারলেন না। এই সময় দক্ষিণ আফ্রিকার আবদুল্লা কোম্পানির একটি মামলা পরিচালনা করার ব্যাপারে গান্ধীর ভাইয়ের কাছে সংবাদ পাঠালেন, তবে তার সমস্ত খরচ ছাড়াও মাসে একশো পাঁচ পাউন্ড দেবেন। গান্ধী এই প্রস্তাব মেনে নিলেন এবং ১৮৯৩ সালের এপ্রিল মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার পথে রওনা হলেন। এই সময় দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার একটি ঘোষণায় ভারতীয়দের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করবার হুকুম জারি করে। এই অবিচারের বিরুদ্ধে গান্ধী তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তিনি স্থির করলেন এই অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করবেন।
গান্ধীর এই আন্দোলন সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে অভূতপুর্ব উদ্দীপনার সৃষ্টি করল এবং প্রায় দশ হাজার ভারতীয়ের স্বাক্ষর দেওয়ার এক দরখাস্ত উপনিবেশ মন্ত্রী লর্ড রিপনের কাছে পাঠানো হল। মূলত তাঁরই চেষ্টায় ১৮৯৪ সালের ২২ শে মে জন্ম হল নাটাল ভারতীয় কংগ্রেসর। গান্ধী হলেন তার প্রথম সম্পাদক । এর পর তিনি কয়েক মাসের জন্য ভারতবর্ষে ফিরে এসে নিজের পরিবারের লোকজনকে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা রহনা হলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রান্সভাল ও অরেঞ্জিয়া প্রদেশে বুয়র সম্প্রদায়ের প্রভুত্ব ছিল। এই বুয়রদের সাথে সোনার খনির কর্তৃত্ব নিয়ে ১৮৯৯ সালে ইংরেজদের যুদ্ধ হল।  গান্ধী বুয়রদের সমর্থন না করে রাজভক্ত প্রজা হিসাবে ইংরেজদের সেবা করবার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী তৈরি করলেন। এই বাহিনী আহত ইংরেজ সৈন্যদের সেবা করে যথেষ্ট প্রসংশা অর্জন করেছিল । এই যুদ্ধের পরবর্তীকাল থেকে গান্ধীর জীবনে এক পরিবর্তন দেখা দিল। তিনি সাদাসিদা জীবন যাপন করতে আরম্ভ করলেন।
১৯৬০ সালে ট্রান্সভালে এক অর্ডিনান্স জারি করে আট বছরের উপরে সব ভারতীয় নারী- পুরুষকে নাম রেজিস্ট্রী করার আদেশ দেওয়া হয় এবং সকলকে দশ আঙ্গুলের ছাপ দিতে হবে বলে নতুন আইনে ঘোষণা করা হয়।
এতে গান্ধী তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করেন। এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিকার করার জন্য ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ করে প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ করেন। গান্ধী আরো বহু ভারতীয়দের সাথে বন্দী হলেন। বিচারে তার দু মাস কারাদন্ড হল । এই প্রথম কারাবরণ করলেন গান্ধী। ১৫ দিন পর সরকার কিছুটা নরম হলেন। গান্ধীর সাথে চুক্তি হল ভারতীয়রা যদি স্বেচ্ছায় নাম রেজিস্ট্রি করে তবে এই আইন তুলে নেওয়া হবে। অনেক সম্প্রদায় এই আ্ইন মেনে নিলেও পাঠানেরা তা মেনে নিল না, তাদের ধারণা হল গান্ধীজি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।
গান্ধীর আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও ইংরেজরা তাঁর কোন দাবি মেনে নেয় না। সত্যাগ্রহ আন্দোলন ক্রমশই বেড়ে চলে। গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দোলনের ভার অন্যদের হাতে তুলে দিয়ে প্রথমে ইংল্যান্ডে যান কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় ভারতে ‍ফিরে এলেন। ১৯১৫ সালে আহমেদাবাদের কাছে কোচরার নামে এক জায়গায় সত্যাগ্রহ আশ্রম প্রতিষ্ঠিত করলেন।
সেই সময় ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে শ্রমিক দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানো হত। এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবারে সোচ্চার হয়ে উঠলেন গান্ধী। কিছুদিনের মধ্যেই এই‌  আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করল। এর ফলশ্রুতিতে ১৯১৭ সালের ৩১ শে জুলাই ভারত থেকে শ্রমিক পাঠানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল।
১৯১৮ সাল, ইউরোপের বুকে তখন চলেছে বিশ্বযুদ্ধ। ইংরেজরাও এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল । বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ড দিল্লীতে গান্ধীকে ডেকে পাঠালেন । তিনি এই যুদ্ধে ভারতীয়দের ইংরেজ পক্ষ সমর্থনের জন্য অনুরোধ করলেন।
গান্ধীর ধারণা হয়েছিল ভারতবাসী যদি ইংরেজদের সাহায্য করে। অচিরেই সেই  ধারণা ভুল  প্রমাণিত হয়েছিল। ইংরেজদের প্রতি তাঁর এক মোহ ছিল যা থেকে তিনি কোনদিনই মুক্ত হতে পারেননি। যুদ্ধের পর সকলেই আশা করেছিল ভারতবাসী স্বায়ওশাসন পাবে। কিন্তু তার পরিবর্তে বড়লাট রাউলাট আইন নামে এক দমনমূলক আইন পাম করলেন। এতে বলা হলো কেউ সামান্যতম সরকারি- বিরোধী কাজকর্ম করলে তাকে বিনা বিচারের বন্দী করা হবে।
১৩ই এপ্রিল রামনবমীর মেলা উপলক্ষে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামে এক জায়গায় কয়েক হাজার মানুষ জড় হল। জায়গাটার চারদিকে উঁচু পাঁচিল বার হবার একটি মাত্র পথ। ডায়ারের নির্দেশ সেই নিরীহ জনগণের উপর ‍নির্মম ভাবে গুলি চালান হল । কয়েক হাজার মানুষ হতাহত হল। এই ঘটনায় সমস্ত দেশ ক্ষোভে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। বহু জায়গায় হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু হল। গান্ধী সত্যাগ্রহ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল । তিনি নিজেই তাঁর ভুল স্বীকার করলেন। নাগপুরে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে (১৯২০) গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব সমর্থিত হল।
গান্ধী ইংরেজ সরকারের সাথে সহযোগিতা করতে নিষেধ করলেন। তিনি বললেন, সব সরকারী স্কুল-কলেজ, আইন-আদালতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। ব্যবস্থাপক সভা বর্জন করতে হবে। বিদেশী দ্রব্য বর্জন করতে হবে। স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য চরকা ও তাত প্রচলন করতে হবে। গান্ধীর এই ডাকে দেশ জুড়ে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেল। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদেশী বস্ত্র পোড়ানো শুরু হল। লোকে চরকায় বোনা কাপড় পরতে  আরম্ভ করল।
১৯২২ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি উত্তর প্রদেশের চৌরিচৌরা নামক স্থানে উত্তেজিত জনতা কিছু পুলিশকে হত্যা করল। এর প্রতিবাদে তিনি আন্দোলন বন্ধ করে দিলেন। গান্ধীকে গ্রেফতার করা হল । দেশব্যাপী আন্দোলনের দায় গান্ধীজি নিজেই স্বীকার করে নিলেন। বিচারে তার ছয় বছরের কারাদন্ড দেওয়া হল। জেলে  তিনি চরকা কাটতে চাইলেন। কিন্তু তাঁকে সে অনুমতি দেওয়া হল না। ‍তিনি উপবাস শুরু করলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর সব দাবি মেনে নেওয়া হল। কিন্তু  কিছুদিন পূর্বেই  তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এই অসুস্থতার জন্যেই তাকে ১৯২৪ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি মুক্তি দেওয়া হল। ১৯২৫,২৬,২৭ সালে গান্ধীজি কংগ্রেসের অধিবেশনে উপস্থিত থাকলেও তাতে সক্রিয়াভাবে অংশগ্রহণ করেননি। সুভাষচন্দ্র ও জহরলাল পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলে একটি প্রস্তার আনতে চান।
১৯৪০ সালে গান্ধীজী শান্তিনিকেতনে এলেন। কবিগুরুর সাথে ছিল তাঁর মধুর এবং আন্তরিক সম্পর্ক । শান্তিনিকেতনের কাজে গান্ধী নানাভাবে রবীন্দ্রনাথকে সাহায্য করেছেন।
এই বছরেই রামগড়ে কংগ্রেস অধিবেশন বসল। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হলেন। এই অধিবেশনে ঘোষণা করা হল একমাত্র পূর্ণ স্বাধীনতাই ভারতের কাম্য। গান্ধীকে পনরায় দলের নেতা হিসাবে নির্বাচিত করা হল। শুরু হল সত্যাগ্রহ আন্দোলন।
৯ই আগস্ট ১৯৪২ সালে বোম্বাইতে নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির সভায় ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব গৃহীত হল। সাথে সাথে কংগ্রেসের সমস্ত নেতাকে গ্রেফতার করা হল। গান্ধী , সরোজিনী নাইডু, মহাদেব দেশাই, মীরাবেনকে বন্দী করে আগা খাঁ প্রাসাদে রাখা হল।
সমস্ত ভারতবর্ষ উত্তাল হয়ে উঠল। শুরু হল গণবিক্ষোভ । পুলিশের হাতে প্রায় ১০০০ লোক মারা পড়ল।
গান্ধীর শরীরের অবস্থাও ক্রমশই খারাপের দিকে যেতে থাকে। ইংরেজ সরকার অনুভব করতে পারল কারাগারের গান্ধীর কোন ক্ষতি হলে সমস্ত বিশ্বের কাছে তাদের কৈফিয়ৎ দিতে হবে তাই বিনা শর্তে গান্ধীকে মুক্তি দেওয়া হল।
১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল-ইংল্যান্ডে সাধারণ নির্বাচনে শ্রমিকদল জয়ী হল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইংল্যান্ডকে এতখানি বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল তারা উপলব্ধি করতে পারছিল ভারতের স্বাধীনতার দাবিকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভবপর নয়।
এদিকে দেশের মধ্যে হিন্দু-মুসলামদের বিভেদ ক্রমশই প্রবল আকার ধারণ করতে থাকে। শুরু হল ভয়াবহ দাঙ্গা।
পরস্পরিক এই দাঙ্গাবিভেদে গান্ধী গভীর দুঃখিত হয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন হিন্দু- মুসলমানের ঐক্য, পরস্পরের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ নয়। কিন্তু তিনি বেদনাহত হলেন। দেশ বিভাগের মধ্যে দিয়ে  ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করল।
দিল্লীতেও তখন নানান সমস্যা। একদিকে দাঙ্গাপীড়িত মানুষ, মন্ত্রিসভায় মতানৈক্য, খাদ্য- বস্ত্রের সমস্যা। দিল্লীতে মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্য তিনি অনশন করলেন এবং এই তাঁর শেষ অনশন। সম্মিলিত সকলের অনুরোধে ১৮ই জানুয়ারি অনশন ভঙ্গ করলেন। এই সময় গান্ধী নিয়মিত প্রার্থনাসভায় যোগ দিতেন। ৩০শে জানুয়ারি তিনি প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে চলেছেন এমন সময় ভিড় ঠেলে তার সামনে এগিয়ে এল এক যুবক। সকলের মনে হল সে বোধ হয় গান্ধীকে প্রণাম করবে। কিন্তু কাছে এসেই সে সামনে ঝুকেঁ পড়ে পর পর তিনবার পিস্তলের গুলি চালাল। দুটি গুলি পেটে, একটি বুকে বিধল। সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন গান্ধী। তার মুখ থেকে শুধু দুটি শব্দ বার হল “ হে রাম” । তারপরই সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
সমস্ত দেশ শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল-পরদিন যমুনার তীরে চিতার আগুনে তাঁর পার্থিব দেহ ভস্মীভূত হয়ে গেল। দেশ-বিদেশ থেকে মানুষেরা শ্রদ্ধাঞ্জলী পাঠালেন। তাদের মধ্যে ছিলেন দেশবরেণ্য মানুষেরা। তাদের সকলের কাছে গান্ধী ছিলেন বিপন্ন মানব সভ্যতার সামনের একমাত্র আশার আলো।

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.

[blogger]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget