আগমলোক
সিল্করুট বা রেশমপথের প্রবেশদ্বার বলা যেতে পারে লিংতামকে। অনুমতিপত্র পরীক্ষার পর লিংতাম থেকেই শুরু হয় রেশমপথ পরিক্রমা। আগমলোকের অবস্থান হল আপার লিংতামে। উচ্চতা ৬০০০ ফুট। মাত্র ৪৫০০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট লিংতামে থাকার চেয়ে আগমলোকে রাত্রিবাস করলে বেশি উচ্চতার রেশমপথে যাওয়ার আগে শরীরকে উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কাজটাও হয়ে যায়।এমনিতেও ভারি চমৎকার জায়গা এই আগমলোক। বেশ খানিকটা উপর থেকে পাখির চোখে ধরা পড়ে সবুজে মোড়া লিংতাম উপত্যকার এক অনিন্দ্যসুন্দর ছবি। কাছেই আছে এক ছোট্ট গুম্ফা। সুন্দর পরিবেশে অবস্থিত গুম্ফা চত্বর থেকে তুষারশৃঙ্গের দৃশ্যও চোখে পড়ে। আর কাঞ্চনজঙ্ঘা সমেত অন্যান্য তুষারশৃঙ্গের অনবদ্য দৃশ্য দেখতে হলে চলে যান ভিউ পয়েন্টে।
গাড়িরাস্তা থেকে সামান্য পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলে ভিউপয়েন্ট থেকেই দেখতে পাবেন হিমালয়ের তুষারশৃঙ্গশ্রেণির সেই অসাধারণ দৃশ্য। অপার নির্জনতার মাঝে সুন্দরের আরাধনায় ব্রতী আগমলোক বাস্তবিকই মুগ্ধ করবে।
আগমলোক থেকে লিংতাম।
যাত্রাপথ
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে আগমলোকের দূরত্ব ১৩৫ কিলোমিটার। পুরো গাড়ি রিজার্ভ করলে ভাড়া পড়বে ৩০০০-৪০০০ টাকা। কম খরচে আসতে চাইলে, এনজেপি বা শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটকগামী শেয়ার জিপ কিংবা বাসে রংপো নেমে, সেখান থেকে শেয়ার জিপ বা গাড়িভাড়া করে পৌঁছে যান আগমলোক।
সিল্করুট (রেশমপথ)
তুষারাবৃত সিল্করুট।
অতীতে এই পথেই বাণিজ্য চলত ভারত থেকে তিব্বত হয়ে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত। এখন বাণিজ্য বন্ধ হলেও (শুধুমাত্র নাথুলা সীমান্ত হয়ে ভারত-চিন বাণিজ্য চলে এখন বছরের কিছু বিশেষ সময়ে), পর্যটকদের কাছে বৈচিত্র্যের জন্য এ পথ কিন্তু খুবই আকর্ষণীয় হিসাবে বিবেচিত হয়।
লিংতাম থেকে যাত্রা শুরু করে পদমচেন, জুলুক হয়ে পৌঁছে যান থাম্বি ভিউ পয়েন্ট। ১১২০০ ফুট উচ্চতা থেকে এক দিকে যেমন দেখতে পাবেন কাঞ্চনজঙ্ঘা ও অন্যান্য তুষারশৃঙ্গের দারুণ দৃশ্য, অন্য
দিকে, ফেলে আসা পথের প্রতিটা বাঁকের একত্রিত দৃশ্যও (জুলুক লুপ্স বা ভুলভুলাইয়া নামে খ্যাত) নজর কাড়বে। থাম্বি ভিউ পয়েন্টের পরের বাঁকেই অবস্থিত ধূপিদাঁড়া (উচ্চতা ১১৩০০ ফুট) থেকেও ভারি চমৎকার দেখায় কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ সমগ্র তুষারশৃঙ্গশ্রেণিকে। এখানে হোমস্টে-ও আছে রাত্রিবাসের জন্য। ১২৬০০ ফুট উচ্চতার লুংথুং থেকে সেই তুষারশৃঙ্গশ্রেণিকেই যেন দেখবেন একেবারে সোজাসুজি। অনেকে সূর্যোদয় দেখতেও ভোররাতে চলে আসেন এখানে।
কুপুপ লেক।
এরপর গাড়ি চলে যাবে ১৩৯০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত নীলরঙা কুপুপ লেকে। এই কুপুপ লেকই হল জলঢাকা নদীর উৎস। ১৪০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এশিয়ার সর্বোচ্চ গলফ্ কোর্সটির (বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) অবস্থানও এর কাছেই। পুরনো বাবামন্দিরের (বাবা হরভজন সিংহের স্মৃতিমন্দির) পাশেই দেখেতে পাবেন বাবা হরভজন সিংহ যে বাঙ্কারে পাহারা দিতেন, সেটিও।
১২৫০০ ফুট উচ্চতার তুক্লা ভ্যালি থেকেও তুষারশৃঙ্গরাজির অপূর্ব দৃশ্য চোখে পড়বে। এর পর নতুন বাবামন্দির, ছাঙ্গু লেক হয়ে চলে যেতে পারেন গ্যাংটক। কিংবা নাথাং ভ্যালি, লুংথুং, জুলুক হয়ে একই পথে ফিরে আসতে পারেন লিংতাম বা আগমলোকে।
এই বাঙ্কারে পাহারা দিতেন হরভজন সিংহ।
যাত্রাপথ
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে লিংতামের দূরত্ব ১২৭ কিলোমিটার, আগমলোকের দূরত্ব ১৩৫ কিলোমিটার। এখান থেকে জুলুক, লুংথুং হয়ে বাবামন্দির অবধি পুরো রেশমপথের দৈর্ঘ্য হল মাত্র ৬০ কিলোমিটার। তাই আগমলোক বা লিংতামে রাত্রিবাস করেই ঘুরে নিতে পারেন পুরো রেশমপথটিই। পুরো গাড়ি রিজার্ভ করলে ভাড়া পড়বে ৩৫০০-৪০০০ টাকা।
সিল্করুটের বিখ্যাত লুপ
রাত্রিবাস
উচ্চতাজনিত কারণে রেশমপথে রাত্রিবাস করার বেশ কিছু অসুবিধা রয়েছে। অনিয়মিত বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জ, কিংবা মোবাইল চার্জের ক্ষেত্রে অসুবিধা হয়। মোবাইল ফোনে নেটওয়ার্কই থাকে না বেশির ভাগ জায়গায়। হঠাৎ বৃষ্টি পড়লে তাপমাত্রার আচমকা পতন অনেকসময়ই স্বস্তিদায়ক হয় না, বিশেষত বয়স্ক বা শিশুদের জন্য। এখন রেশমপথে যে সব জায়গায় হোমস্টে-তে (জুলুক কিংবা নাথাংভ্যালি) রাখা হয়, তার বেশির ভাগ থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা কিংবা অন্যান্য তুষারশৃঙ্গের দৃশ্য বিন্দুমাত্র দেখা যায় না। ফলে বহু অসুবিধা সয়ে রাত্রিবাস করলেও, তুষারশৃঙ্গ দেখার বাসনা অপূর্ণ থেকে যায়।
ধূপিদাঁড়া থেকে দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘা।
তাই এ পথে একান্ত যদি রাত্রিবাস করতেই হয়, তবে থাকতে পারেন ধূপিদাঁড়ায় (থাম্বি ভিউ পয়েন্টের ঠিক পরে)। যেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ অন্যান্য তুষারশৃঙ্গের ছবি চমৎকার দৃশ্যমান। ধূপিদাঁড়ায় আছে ‘লামাখাংগ হোমস্টে’। চারশয্যা ঘর আছে চারটি। প্রতি দিনের মাথাপিছু খরচ (খাওয়া-থাকা নিয়ে) ৯০০-১০০০ টাকা।
যোগাযোগ: ৯৯৩৩৪৭১২০২, ৮৪৩৬৬৪৯০০১
জরুরি তথ্য
সপ্তাহের কাজের দিনে রংগলি এসডিপিও অফিস থেকে পাওয়া যায় রেশমপথে ঘোরার প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র। ভোটার কার্ডের এক কপি ফটোকপি ও পাসপোর্ট সাইজ ছবির এক কপি দিয়ে আবেদন করলে সহজেই মেলে এই অনুমতি। আগমলোকের হোটেলে আগে থেকে বলে রাখলে তারাও আনিয়ে দিতে পারে এই অনুমতিপত্র। তবে নাথুলা কিংবা মেমেঞ্চো ভ্রমণের অনুমতি এখান থেকে মেলে না, গ্যাংটক থেকেই দেওয়া হয়। সম্প্রতি ডকুমেন্ট হিসেবে আধার কার্ডকে মান্যতা দেওয়া হচ্ছে না এপথে অনুমতির ক্ষেত্রে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে স্কুল কিংবা কলেজের ফটো আইডেন্টিটি কার্ড দেখালেও চলবে।
অপূর্ব রিসি নদী
সিংতাম-টার
সিকিমে নিভৃত অবকাশযাপনে পাহাড়ের সঙ্গে নদীর যুগলবন্দি উপভোগ করতে হলে সিংতাম-টার হতে পারে আদর্শ ঠিকানা। অপূর্ব রিশি (বা রেশি) নদী এখানে বয়ে চলেছে উপত্যকার বুক চিরে। উচ্ছ্বল সে নদীর সর্পিল যাত্রাপথকে আকর্ষণীয় করে তোলে নদীর বুকে ওঠা ছোট ছোট ঢেউয়ের নিরন্তর প্রবাহ। জলতরঙ্গের সেই সুমধুর ধ্বনি যখন শুনবেন নরম রোদে পিঠ দেওয়া কোনও অলস মধ্যাহ্নে, তখন আপনাকে চারপাশ থেকে ঘিরে থাকবে সবুজ পাহাড়ের দৃষ্টিনন্দন ঘেরাটোপ। ৩০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই সিংতাম-টারে রিশি নদী আলাদা করেছে দুই রাজ্যের সীমানা। নদীর ওপারটাই হল রেশিখোলা, যেটির অবস্থান বাংলায়। তবে রেশিখোলায় গাড়ি থেকে নেমে বেশ কিছুটা পায়ে হেঁটে তবে পৌঁছনো যায় হোটেলে। আর সিংতাম-টারে গাড়ি চলে আসে সরাসরি রিসর্ট অবধিই। নদীর টাটকা ও সুস্বাদু মাছ যদি মিলে যায় লাঞ্চ অথবা ডিনারের মেনুতে, তবে তো কথাই নেই! একেবারে সোনায় সোহাগা!যাত্রাপথ
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে সিংতাম-টার ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পুরো গাড়ি রিজার্ভ করলে ভাড়া পড়বে ৩০০০-৩৫০০ টাকা। কম খরচে আসতে চাইলে শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটকগামী শেয়ার জিপ বা বাসে এসে নেমে পড়তে হবে রংপো। সেখান থেকে অন্য গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছে যান মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরের সিংতাম-টার।
৬৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত মাংখিম।
আরিতার
৪৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই লেকের আসল নাম লামপোখরি হলেও, পর্যটকমহলে জনপ্রিয়তা বেশি আরিতার নামেই। চারপাশে উঁচু পাহাড়ে ঘেরা পান্নাসবুজ জলের লেকে ইচ্ছে করলে ভেসেও পড়তে পারেন প্যাডেল-বোটে। লেকের চারপাশ দিয়ে বাঁধানো রাস্তা ধরে প্রদক্ষিণও করে নিতে পারেন পুরো লেকটি। তবে স্থানীয় রীতি মেনে, বাঁ দিক থেকে হাঁটা শুরু করে ডানপ্রান্তে এসে শেষ করতে হবে।লেকের কাছ থেকেই আলাদা হওয়া চড়াই রাস্তা ধরে পৌঁছে যান মাংখিম। ৬৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই মাংখিম থেকে এক দিকে যেমন পাখির চোখে ধরা পড়ে পুরো আরিতার লেকটি, অন্য দিকে দূর আকাশে নজরে পড়বে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও অন্যান্য তুষারশৃঙ্গের সুন্দর দৃশ্য।
মাংখিম থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
যাত্রাপথ
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে আরিতার লেকের দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার (রংপো হয়ে)। পুরো গাড়ি রিজার্ভ করলে ভাড়া পড়বে ৩০০০-৩৫০০ টাকা। এ ছাড়া গ্যাংটকগামী শেয়ার জিপ বা বাসে রংপো এসে, সেখান থেকেও গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছতে পারেন আরিতার, তাতে খরচও খানিকটা কম হবে।
রংপো নদী।
লোসিং
রংপো নদী এখানে বয়ে চলেছে আপন ছন্দে। ঘন জঙ্গলে ঢাকা উচ্চকায় সবুজ পাহাড়ের বেষ্টন চারপাশে। রংপো নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে এই পর্যটনকেন্দ্র। নদীর তীরে ছড়ানো অজস্র বড় পাথরের কোনওটাতে বসে, কিংবা নদীর উপর নির্মিত বহু পুরনো সেই কাঠের সেতুতে (যেখান দিয়ে হেঁটে গেলেই দুলে দুলে উঠে অভ্যর্থনা জানাবে সেতু) দাঁড়িয়ে নদীর চমৎকার প্রবাহ দেখতে দেখতেই সময় কেটে যাবে।
রংপো নদীর ধারে লোসিং।
লোসিং-এর উচ্চতা ৩০০০ ফুট। কাছাকাছির মধ্যে গাড়িভাড়া করে দেখে নিতে পারেন পাখি ও প্রজাপতিতে ভরপুর রংপো ড্যাম, মাছং গুম্ফা, হরপার্বতীর মন্দির ইত্যাদি দর্শনীয় স্থানগুলি।
যাত্রাপথ
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে লোসিং-এর দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। পুরো গাড়ি রিজার্ভ করলে ভাড়া পড়বে ৩৫০০-৪০০০ টাকা। পাকইয়ং থেকেও চলে আসতে পারেন ৪০ কিলোমিটার দূরবর্তী লোসিং-এ (ছুজাচেন থেকে দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার)। পুরো গাড়ির খরচ পড়বে ১০০০-১৫০০ টাকা।
আসাম লিংজে গ্রাম।
পাস্তাংগা
পর্যটন মানচিত্রে এখনও তেমন পরিচিত হয়ে ওঠেনি এ জায়গা। তাই ট্যুরিস্টের ভিড়ও প্রায় নেই বললেই চলে। ৪৬৭৬ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত পাস্তাংগা কিন্তু নিরাশ করবে না। কাছাকাছি আছে আরও বেশ কয়েকটি গ্রাম। যেমন গৈরিগাঁও, আসাম লিংজে ইত্যাদি। সব জায়গাতেই গ্রামের মধ্যে হোমস্টে চালু হয়েছে এখন। ১৫০ বছরের প্রাচীন হেরিটেজ হাউস (রাই ও ভুটিয়া সম্প্রদায়ের), সুম্নিওয়ারি ঝর্না ইত্যাদি দ্রষ্টব্যগুলি দেখে নিতে পারেন কাছেপিঠের মধ্যে।অত্যুৎসাহীরা ট্রেক করে ৪-৫ ঘণ্টার হাঁটায় যেতে পারেন ঢুঙ্গেলখড়কা (৭০০০ ফুট) কিংবা ২ দিনের হাঁটায় পৌঁছে যেতে পারেন খেদি (৯২০০ ফুট)। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে এ সব জায়গা থেকে হিমালয়ের হিমশিখরশ্রেণির এক অনবদ্য দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাবে। বিভিন্ন ধরনের ওষধি গাছও জন্মায় পাস্তাংগা ও আশপাশের গ্রামগুলিতে। বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিডের দেখাও মেলে এখানে। তোক্চেন নদী বয়ে যায় সবুজ উপত্যকার বুক চিরে। তার গর্ভে মাছেদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। নদীতীরেও কেটে যাবে অনেকটা সময়।
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.