মাক্সিম গোর্কি

মাক্সিম গোর্কি
[১৮৬৮-১৯৩৬]

বাবার নাম ছিল মাক্সিম পেশকভ। মা ভারিয়া। তাদেঁর প্রথম সন্তান আলেক্সেই পেশকভের জন্ম হয় ১৮৬৮ সালের ২৮শে র্মাচ। পিতৃদত্ত এই নাম মুছে গিয়ে গোকিং নামেই উত্তরকালে তিনি জগৎবিখ্যাত হন। বাবা মারা যাবার পর মার সাথে এসে মামার বাড়ি নিজনি নভগরোদ শহরে। কিছুদিন পর স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হলেন। ইতিমধ্যে মা আরেকজনকে বিয়ে করেছেন। হঠাৎ করে মা মারা গেলেন। দাদামশাই আর গোর্কির দায়িত্বভার নিতে চাইলেন না।
মায়ের শেষকৃত্যের কয়েকদিন পরেই তাকে ডেকে বললেন, ” তোমাকে এভাবে মেডেলের মত গলায় ঝুলিয়ে রাখব তা তো চলতে পারে না। এখানে আর তোমার জায়গা হবে না। এবার তোমার দুনিয়ার ঘাটে বেরুবার সময় হয়েছে।”
শুরু হল গোর্কির নতুন জীবন। শহরের সদর রাস্তার উপর এক শৌখিন জুতোর দোকানের বয়। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম। একদিন দোকানের চাকরি ছেড়ে দিলেন। কিছুদিন পথে পথে ঘুরে বেড়ালেন। একটা কয়েদি জাহাজে চাকরি পেলেন। যাদের নির্বাসন দেওয়া হত তাদের সেই জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হত। জাহাজের কমচারীদের বাসন ধোয়ার কাজ ছিল গোর্কির। ভোর ছটা থেকে মাঝ রাত অবধি কাজ। তাঁরই ফাঁকে ফাঁকে দু চোখ ভরে দেখতেন নদীর অপরুপ রূপ। দু পারের গ্রামের দৃশ্য।
হিসেবপত্র মিটিয়ে হাতে আট রুবল নিয়ে ফিরে এলেন নিজের শহর নিজনি নভগরোদে। জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাতে এক পেশা থেকে আরেক পেশায় ঘুরতে ঘুরতে বড় হয়ে উঠতে থাকেন গোর্কি। সব কিছুর মধ্যেও বই পড়ার নেশা বেড়ে চলে। বইয়ের কোন বাদবিচার ছিল না। সবভূকের মত যা পেতেন তাই পড়তেন। একদিন হাতে এল মহান রুশ কবি পুশকিনের একটি কবিতার বই। পড়তে পড়তে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন।
তখন রাশিয়ার জারের রাজত্বকাল। দেশ জুড়ে চলছিল শাসনের নামে শোষণ অত্যাচার। বিপ্লবী দলের সাথে যুক্ত হয়েই গোর্কি পরিচিত হলে  মাক্সের রচনাবলীর সাথে। অথনীতি, ইতিহাস, সমাজনীতি, দশন, আরো নানান বিষয়ের বই পড়তে আরম্ভ করলেন।
দারিদ্র্য ছিল তার নিত্যসঙ্গী। কিছুদিন পর একটি রুটি কারখানায় কাজ পেলেন। সন্ধ্যে থেকে পরদিন দুপুর অবধি একটানা কাজ করতে হত। তারই ফাকে যেটুকু সময় পেতেন বই পড়তেন। তার এই সময়কার জীবনে অভিজ্ঞতার কাহিনী অবলম্বনে পরবর্তীকালে লিখেছিলেন বিখ্যাত গল্প “ছব্বিশজন লোক আর একটি মেয়ে।”
রুটির কারখানায় কাজ করবার সময় পুলিশের সন্দেহ পড়েছিল তার উপর। সুকৌশলে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতেন গোর্কি। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে করতে মনের সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তার উপর যখন সন্দেহ অবিশ্বাস ; নিজের উপরেই সব বিশ্বাসটুকু হারিয়ে ফেলতেন। মনে হত এই জীবন মূল্যহীন, বেঁচে থাকবার কোন অথ নেই।
বাজার থেকে একটি পিস্তল কিনলেন। ১৮৮৭ সালের ১৪ই ডিসেম্বর নদীর তীরে গিয়ে নিজের বুকে গুলি করলেন। গুরুতর আহত অবস্থায় থাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল।
ডাক্তাররা জীবনের আশা ত্যাগ করলেও অদম্য প্রাণশক্তির জোরে বেঁচে গেলেন গোর্কি।
এক বৃদ্ধ বিপ্লবী মাঝে মাঝে রুটির কারখানায় আসতেন। সুস্থ হয়ে উঠতেই গোর্কিকে নিয়ে গেলেন নিজের গ্রামের বাড়িতে।
গল্পটি প্রকাশিত হল ১৮৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এই গল্পে বাস্তবতার চেয়ে রোমান্টিকতার প্রভাবই বেশি।
নিজনি শহরে থাকতেন তরুণ লেখক ভ্লাদিমির করোলেষ্কা। একদিন গোর্কির সাথে পরিচয় হল। করোলেষ্কার কথায় চেতনা ফিরে পেলেণ গোর্কি। প্রথাগত রচনার ধারাকে বাদ দিয়ে শুরু হল তার নতুন পথে যাত্রা। সমাজের নিচুতলার মানুষেরা- চোর, লম্পট, ভরঘুরে তামাল, গণিকা, চাষী, মজুর, জেলে, সারিবদ্ধভাবে মিছিল করে প্রকাশ পেতে থাকে তার রচনায়। এই পর্বের কয়েকটি বিখ্যাত গল্প হর শালভা বুড়ো ইজেরগিল, চেলকাশ, একটি মানুষের জন্ম। গল্পগুলির মধ্যে একদিকে যেমন ফুটে উঠেছে নিচুতলার মানুষের প্রতি গভীর মমতা অন্যদিকে অসাধারণ বণর্না, কল্পনা আর তাঁর সৃজনশক্তি।

এই সব লেখাগুলি বেশির ভাগ ছাপা হয়েছিল ভলগা তীরের মফস্বলী পত্রিকায় স্থানীয় মানুষ, কিছু লেখক সমালোচক তাঁর রচনা পড়ে মুগ্ধ হলেন। তখনো যশ খ্যাতি পাননি গোর্কি। ১৮৯৮ সালে তাঁর প্রবন্ধ ও গল্প নিয়ে একটি ছোট সংকলন প্রকাশিত হল। সংকলনের নাম দেওয়া হল “রেখাচিত্র ও কাহিনী”। এই বই প্রকাশের সাথে সাথে গোর্কির খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সেই সময় রাশিয়ার প্রধান সাহিত্যিক ছিলেন চেখভ, তলস্তয়। তাঁদের সাথে গোর্কির নামও উচ্চারিত হতে থাকে।
এক বছর পর প্রকাশিত হল গোর্কির প্রথম সাথক উপন্যাস “ফোমা গর্দেয়ভ” (১৯০০)। একই সময়ে প্রকাশিত হল তলস্তয়ের উপন্যাস “রেজারেকসন”। দুটি উপন্যাসই রাশিয়ার মানুষের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠল। গোর্কির রচনার বাস্তবতা, তার জীবনধর্মীতা, নিপীড়িত অবহেলিত মানুষের প্রতি সমবেদনা মমতা; স্বভাবতই রুশ শাসকদের বিচলিত করে তুলল। তাঁর আগে সমাজ জীবনকে এমন নিমমভাবে কেউ প্রকাশ করেনি।
গোর্কিকে বন্দী করা হল। কর্তৃপক্ষ চেয়েছিল কোন মিথ্যা অজুহাতে তাঁকে শাস্তি দিতে। কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল।
দেশ জুড়ে বিপ্লবী আন্দোলন ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছিল। ১৯০১ সাল, গোর্কি তখন ছিলেন সেন্ট পিটসর্বাগ শহরে। একদিন ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদশন করছিল। পুলিশ তাদের উপর গুলি চালাল। অনেক নিহত হল। অসংখ্য ছাত্র আহত হল। এর প্রতিবাদে গোর্কি লিখলেন কবিতা “ঝোড়ো পাখির গান”।
ঝিড়ের গান ছড়িয়ে পড়ল হাজার হাজার মানুষের মুখে। গোর্কির কবিতা যেন বিপ্লবের মন্ত্র। গোর্কিকে আটক করা হল। এখন আর তিনি নিজনি নভগোরদ শহরের এক সামান্য কারিগর নন, রাশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক। তাঁকে গ্রেফতারে প্রতিবাদে দেশ জুড়ে ঝড় উঠল। তাদের মুখপাত্র হলেন স্বয়ং তলস্তয়। জারের কমচারীরা তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল।
ক্রমশই গোর্কি পরিচিত হয়ে উঠছিলেন লেনিনের আদশ, তাঁর মতবাদ। তিনি হয়ে উঠলেন মানবিকতার সমস্যায় গভীর আলোড়িত এক শিল্পী। বহু বিপ্লবী নেতাই তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য আসত। গোর্কি নিয়মিত তাদের সাথে যোগাযোগ করতেন। তিনি হলেন জার কর্তৃপক্ষের চোখে এক বিপদজনক ব্যাক্তি। তাঁকে নির্বাসিত করা হল আরজামাস নামে একটা ছোট শহর। গোর্কি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তলস্তয় ও দেশের বুদ্ধিজীবীর সম্মিলিতভাবে অবেদন জানালেন। তাঁদের চেষ্টায় গোর্কিকে পাঠানো হল ক্রিমিয়ার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
চেখভের উৎসাহে নাটক লেখা কাজ শুরু করলেন। প্রথম নাটক কূপমণ্ডূক (১৯০১)। এর পর লিখলেন নীচু তলা ( লোয়ার ডেপথ) যা তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক। এই নাটকের বানী সেদিন শুধু রাশিয়া নয়, ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ইউরোপে। গোর্কির নাম ছড়িয়ে পড়ল দেশে দেশে।
১৯০৫ সালে দেশ জুড়ে দেখা দিয়েছিল দুর্ভিক্ষ আর খরা। হাজার হাজার ক্ষুর্ধাত মানুষ জারের প্রসাদ অভিমুখে যাত্রা করল। জারের দেহরক্ষীরা নিমমভাবে গুলি চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করল।
এর বিরুদ্ধে কলম ধরলেন গোর্কি। তিনি সরাসরি দেশের মানুষের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী করলেন জারকে। ক্ষুদ্ধ জারের আদেশে তাঁকে বন্দী করে রাখা হল কারাদুর্গে। এবার শুধু রাশিয়া নয়, প্রতিবাদের ঝড় উঠল সমগ্র ইউরোপে। ইউরোপের শ্রেষ্ঠ মানুষেরা প্রতিবাদ জানালেন। তাঁদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে গোর্কিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল জার সরকার।
শ্রমিকদের আন্দোলন বেড়ে চলছিল। দেশ জুড়ে বিপ্লবের চেষ্টা র্ব্যথ হল।
আবার গোর্কিকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা করা হল। গোপন সূত্রে সংবাদ পেয়ে বিদেশে পাড়ি দিলেন। জামানী ফ্রান্স হয়ে আমেরিকায়। এখানেই শুরু তাঁর বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস “মা”। জারের অত্যাচারের ভয়ে এই বই প্রথমে প্রকাশিত হয় ইংরেজি অনুবাদে (১৯০৬)। এ যাবৎ কমবেশি প্রায় ৩০০ সংষ্করণ বার হয়েছে, এর থেকেই বোঝা যায় ‘মা’ উপন্যাসখানি পৃথিবী জুড়ে কি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
মা ছাড়াও গোর্কি আরো অনেকগুলি উপন্যাস লিখেছিলেন। দুঃখী পাভেল, গ্রীষ্ম, ত্রয়ী। তাঁর আত্মজীবনীমূলক তিনটি উপন্যাস আমার ছেলেবেলা (১৯১৩), পৃথিবীর পথে (১৯১৫), পৃথিবীর পাঠশালায় (১৯২৩)। নিজের জীবনের শৈশব কৈশোর কালের প্রতিটি ঘটনাকে নিপুন শিল্পীর মত যেন রঙের তুলিতে ছবি একেছেন। বাস্তবতার সাথে মানবতার এখন সংমিশ্রণ বিশ্বসাহিত্যে বিরর। জীবনের শেষ পযার্য়ে লেখেন ‘ক্লিম সামগিনের জীবন’।
জীবন শেষ হয়ে আসছিল। কিন্তু জীবন থেকে একটি মুহূর্তের জন্যেও তিনি দূরে সরে যাননি ইউরোপের বুকে একদিকে কমিউনিউজম বিরোধী আন্দোলন, অন্যদিকে জার্মানীতে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব-নিজের গভীর দূরদৃষ্টি দিয়ে গোর্কি অনুভব করেছিলেন এর আসন্ন বিপদ, শয্যাশায়ী অবস্থাতেও তিনি দেশবাসীকে সতক করেছেন। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে (১৮ জুন ১৯৩৬)। তাঁর কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে “যুদ্ধ আসছে…তোমার তৈরি থেক।”
কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর কথা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল।

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.

[blogger]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget