জেমস ওয়াট
[১৭৩৬-১৮১৯]
জেমস ওয়াইট বাষ্পীয় ইজ্ঞিন আবিষ্কার করেছিলেন- এরকম একটা ধারণাই সাধারণভাবে চালু আছে । আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়। বাষ্পের বৈশিষ্ট্য এবং গুণাগুণ নিয়ে জেমস ওয়াটের নশো বছর আগে থেকেই বৈজ্ঞানিক এবং আবিষ্কারকরা মাথা ঘামিয়ে আসছেন। আসলে জেমস ওয়াট যা করেছিলেন, তা হল বাষ্পীয় শক্তি নিয়ে তাঁর পূর্বসূরীরা যেসব সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন সেগুলিকে বিস্তারিত ভাব বিশ্লেষণ করে তাকে হাতেকলমে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা।খ্রিষ্টের জন্মেরও একশো বছর আগে হিবেরা নামে এক গ্রীক দার্শনিক “এওলিফাইল” বা “এগুলাসের বল” নামে এক অদ্ভুত খেলনার সাহায্য বাষ্পের শক্তিকে কাচে লাগিয়েছিলেন। এই যন্ত্ররুপি খেলনাটিতে ছিল ধাতুর তৈরি নিজের অক্ষের ওপর ঘূর্ণায়মান একটি ফাঁপা গোলক এবং তার নীচে রাখা একটি পানির বড় কড়াই। গোলকটির সাথে লাগানো থাকত মুখ আটকানো সছিদ্র কয়েকটি টিউব। এবার কড়াই এর পানি আগুনে ফুটতে শুরু করলেই গোলকটি বাষ্পে ভরে উঠতে এবং টিউবের ছিদ্র দিয়ে ঢোকা বাতাসের ওপর বাষ্পের চাপ পড়ে গোলক নিজের অক্ষের উপর ঘুরতে শুরু করত।
বাষ্পশক্তি চালিত সম্ভবত: এই প্রথম যন্ত্রটি ষোড়শ শতাব্দীতে গবেষকদের মধ্যে খুবই কৌতূহল ও বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। পরের দু’শতাব্দী ধরেই পন্ডিতের ফুটন্ত পানির বাষ্পের গুণাগুন ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনায় মেতে রইলেন। তাঁরা লক্ষ্য করে দেখলেন যে,বাষ্প দিয়ে যদি কোন নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত ওপরে ঠেলে ওঠে কতটা উঠবে তা অবশ্য নির্ভর করে বাইরের আবহাওয়া মন্ডলে চাপের ওপর। এছাড়া আরো দেখলেন, বাষ্পকে কোন পাত্রে ঘনীভূত করলে সেখানে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয় এবং পানি এসে সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করে। এই দুটি বৈশিষ্ট্যর প্রথমটি ব্যবহার করে সলোমান দ্য কাউস বাষ্পীয় চাপ চালিত ফোয়ারা তৈরী করেছিলেন। একটি গোলাকার পাত্রে দুটি নল আটকানো থাকত : তার মধ্যে প্রথমটি দিয়ে পানি ঢোকানো হত, এবং দ্বিতীয়টি দিয়ে উত্তপ্ত পাত্রের বাষ্পের চাপে ফিনকি দিয়ে পানি বেরোত। আর বাষ্পের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটিকে কাজে লাগিয়ে ক্যাপটেন টমাস স্যাভেরি নামে একজন ইংরেজ সামরিক ইজ্ঞিনিয়ার পাম্প তৈরি করে কর্ণিশ অঞ্চলের টিনের খনি থেকে পানি বার করার কাজে লাগালেন।
স্যাভেরিকে নিয়ে এ সম্বন্ধে একটি ভাল কাহিনী চালু আছে। একদিন একটি সরাইখানায় এক বোতল কিয়াস্তি মদ পান করার পর খালি বোতলটি চুল্লীতে ফেলে দিয়ে উনি একটা পানিপাত্র আনিয়ে তাতে হাত ধুচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর নজরে পড়ল যে বোতলে পড়ে থাকা মদটুকু বাষ্প হয়ে উঠেছে। হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় বোতলটি চুল্লী থেকে বার করে এনে সেটিকে উল্টো মুখ করে পানিতে ঢুকিয়ে দিলেন তিনি এবং অবাক হয়ে দেখলেন যে বোতলের বাষ্পটি ঘনীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোতলের মধ্যে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়ে পাত্রের পানি সেখানে গিয়ে ঢুকছে।
এই সূএটি ধরেই তৈরি হল তাঁর পাম্প। দুটি বড় গোলাকার পাত্র রাখা হল আর একটিতে সঙ্গে বয়লার থেকে বাষ্প ঢোকানো হত। অপরটিতে ঢোকান হত খনির পানি। এরপর বাষ্পের চাপে অন্য একটি নল পানি বাইরে ফেলে দেওয়া হত। কিন্তু এ প্রক্রিয়া বিশেষ কার্যকরী হয়ে ওঠেনি কারণ পাম্প করে যতটুকু পানি বারকরা হত, তার চাইতে বেশি পানি খনিতে এসে ঢুকত। পূর্বসূরীদের মত স্যাভেরিও বাষ্পের অসীম সম্ভাবনার কথা বুঝে উঠতে পারেনি।
বাষ্পকে ঠিকমত প্রথম কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছিলেন টমাস নিউকোমেন (১৬৬৩-১৭১৯)। বাষ্পের সাহায্যে যন্ত্রের অংশবিশেষকে নড়িয়ে তার সাহায্যে অন্য যন্ত্রকে কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি-তাঁর যন্ত্র ছিল পাম্প।
নিউকোমেনের ইঞ্জিনের তলে, ‘চেম্বার’ যুক্ত একটি খাড়া সিলিন্ডার থাকত, সিলিন্ডারটির ভেতরে থাকত একটি ‘পিষ্টন’। আলাদা একটি বয়লরে বাষ্প তৈরি করে তাকে পিষ্টনের নীচে নিয়ে আসা হত। পিষ্টনটি আবার আটকানো থাকত একটি নিজের সমেত ঘূর্ণায়মান বীমের সঙ্গে। এই বীমটির সঙ্গে যে নব বা রডটি থাকত, সেটিই পাম্পটিকে চালু রাখত। প্রথমে সিলিন্ডারটির মধ্যে পাম্প ঢুকিয়ে দেওয়া হত। সিলিন্ডারটিও তার ফলে একটু উঠে যেত। এবার পিষ্টন আর রযের যুক্ত ওঠানামায় পাম্পটি কাজ করত। সিলিন্ডারের মধ্যেকার বাষ্পকে সিলিন্ডারের গায়ে ঠান্ডা জলের ফিনকি দিয়ে ঘনীভূত করে নীচের চেম্বারটিতে এক আংশিক শূন্যস্থান পূরণ করত। পুরো প্রক্রিয়াটিই ছিল খুবই সময়সাপেক্ষ। ঘন্টায় ১৫৬ ফুট গভীরতা থেকে এই ইঞ্জিনে ৫০ গ্যালন (প্রায় ২৫০ লিটার) পানি তোলা যেত। ইঞ্জিনটি চালু রাখতে দুটি লোককে সবসময়েই ব্যস্ত থাকতে হত একজন সারাক্ষণ বয়লারের আগুনের দিকে নজর রাখত, অন্যজন পালা করে দুটি “ভালভ খুলত আর বন্ধ করত একটি পাম্পের, অন্যটি ঠান্ডা পানির।
নিউ কোমেনকেই প্রকৃতপক্ষে বাষ্পীয় শক্তি ব্যবহারের আদি পুরুষ বলা যায়। কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে খুব বেশি জানতে পারা যায়নি। তখনকার দিনে আবিষ্কার বা উদ্ভাবককে প্রায় সবাই খুব অবিশ্বাসের চোখে দেখতেন তাই শ্রদ্ধার বদলে সন্দেহটাই তাঁর বরাতে জুটত বেশি।
প্রথম জীবনে নিউকোমেন ফুটন্ত কেটলির ঢাকনার ওঠানামা নিয়ে যে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন সেটাই পরবর্তীকালে বাষ্পচালিত যন্ত্রের আজীবন গবেষক জেমস ওয়াটের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। অনেকেই মনে করেন জেমস ওয়াটের রোমাঞ্চকর কাজকর্মকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যই এই কাহিনীটি চালু করা হয়েছিল। নিউকোমেন ছিল ডার্টমুখের এক কামার। স্যাভেরিও তাঁর পাম্পের কিছু কিছু ব্যাপারে নিউকোমেনের পরামর্শ নিয়েছিলেন। এবং নিউকোমেও স্যাভেরির কাজ সম্বন্ধে খুব উৎসাহিত হয়ে ওঠে। অবশেষে স্যাভেরির মৃত্যুর পর তাঁর নেওয়া “পেটেন্ট” গুলির মালিক হয়েছিলেন। কোলি নামে তাঁর এক কাজের মিস্ত্রী বন্ধুর তত্ত্বাবধানে পাম্পের ঐ ইঞ্জিনটি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরি হতে থাকে। এরপর সুদীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে নিউকোমেনের এই “আগুনের যন্ত্রটিই” খনি থেকে পানি বার করবার একমাত্র উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
নিউকোমেন কিন্তু তাঁর এই সৃষ্টির জন্য প্রায় কোন স্বীকৃতিই পাননি। বাষ্পচালিত ইঞ্জিন আবিষ্কার করার বেশিরভাগ কৃতিত্বই দেওয়া হয় জেমস ওয়াটকে। এই দাবীর মধ্যে অবশ্য কিছুটা যুক্তি আছে। কারণ ওয়াটই বাষ্পচালিত ইঞ্জিনকে তার সীমিত ক্ষমতার এমন এক উৎস, যাকে অজস্র বিভিন্ন ধরনের কাজে লাগানো যায়। তাঁর বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের নকশা নিখুঁত রূপ পাওয়ার পরে পাম্পের শক্তিকে দিয়ে খনির পানি পাম্প করা, কলকারখানার যন্ত্রপাতি চালানো, ময়দার কল চালানো, সুড়ঙ্গ খোঁড়া, বাড়ি তৈরি করা, জাহাজে বা খনিতে সরানো, পাহাড় বা মরুভূমির ওপর দিয়ে মালপত্র টেনে নিয়ে যাওয়া-এসবই করানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওয়াট আসলে নিউকোমেনের নকশাটিকে উন্নততর করে তুলেছিলেন মাত্র, নিজে কিছু আবিস্কার করেননি।
ওয়াটের এই মাত্রাতিরিক্ত খ্যাতির জন্য মূলতঃ দায়ী একটি প্রচলিত জনপ্রিয় কাহিনী। শৈশবে তাঁর মধ্যে তেমন কোন চোখে পড়ারমত বৈশিষ্ট্য তো ছিল না, বরং আলসে স্বভাবের জন্য ওঁর অভিভাবকরা ওঁকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। একদিন চায়ের টেবিলে ওঁর ওর কাকীমা জেমসকে তো দারুন বকাবকি করে বললেন-“জেমস, তোমার মত কুঁড়ে ছেলে আমি দুটি দেখিনি। হয় পড়াশোনা কর না হয় যাহোক একটা কাজে কাজ কিছু কর। গত এক ঘণ্টা ঘরে দেখছি, তুমি কোন কথাবার্তা না বলে খালি ঐ কেটলির ঢাকনাটা খুলছ, আর বন্ধ করছ। কখনো বা একটা কাপ, আর কখনো বা একটা চামচ নিয়ে বাষ্পের ওপর ধরছ, কি করে কেটলির নল দিয়ে বাষ্পটা বেরোচ্ছে, সেটা মন দিয়ে দেখছ, আর বাষ্প থেকে তৈরি হওয়া পানির ফোটাগুলি হয় গুনছ নয়তো ধরবার চেষ্টা করছো।”
পরবর্তী কালের ভাষ্যকারেরা এই অতিরঞ্জিত কাহিনীর মধ্যে জেমস ওয়াটের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের লক্ষণ খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন। আসলে কিন্তু নেহাৎ আকস্মিকভাবেই তাঁর মনে বাষ্প নিয়ে কৌতূহল দেখা দিয়েছিল। উনি নানারকম যন্ত্রপাতি তৈরি করতেন; সৌভাগ্যক্রমে একবার গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনি কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। কলেজের গবেষণাগারে একটি নিউকোমেনের ইঞ্জিনের মডেল তাঁকে সারাতে দেওয়া হয়েছিল। উনি দেখলেন যে, ইঞ্জিনটির সব যন্ত্রপাতি ঠিক থাকা সত্ত্বেও একবারে কয়েক মিনিটের বেশি সেটি চলছে না। ব্যাপারটা ঘটছে সেটা কিছুতেই তাঁর মাথায় ঢুকছিল না। হঠাৎই এক রবিবারে সকালে বেড়াতে বেড়াতে এমন একটা সমাধান তাঁর মাথায় খেলে গেল, যাতে উনি হয়ে গেলেন “শিল্প বিপ্লবের” জনক। উনি বুঝতে পারলেন, ইঞ্জিনের পক্ষে বয়লারটি খুবই ছোট আর তাই ইঞ্জিনে অহেতুক বাষ্প নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই সমস্যার সমাধান এটাই। কম বাষ্প খরচ হবে। এমন একটি ইঞ্জিন তৈরি করা।
ওয়াট দেখলেন বাষ্পের অপচয় বন্ধ করতে গেলে দুটি জিনিস করতে হবে। প্রথমতঃ যে “চেম্বারে” বাষ্প ঘণীভূত হয়, সেখানকার তাপমাত্রা কম রাখতে হবে; এবং দ্বিতীয়তঃ মূল সিলিন্ডাটির তাপমাত্রা বেশি রাখতে হবে। ওয়াট করলেন কি বাষ্প ঘণীভূত হওয়ার “চেম্বার” টি মূল সিলিন্ডার থেকে আলাদা করে দিলেন। দুটির মধ্যে অবশ্য যোগাযোগের ব্যবস্থা রাখা হল। আলাদা এই “চেম্বার”টিতে বাষ্প ঢুকিয়ে অনবরত ঠান্ডা পানি ঢেলে তাকে ঠান্ডা রেখে বাষ্পকে ঘণীভূত করা হতে লাগল এবং এর ফলে মূল সিলিন্ডারটির তাপমাত্রা না কমিয়েই আংশিক বায়ুশূন্যতা তৈরি করা গেল। এই বায়ু শূন্য অবস্থা ঠিক রাখার জন্য আর ঘণীভূত বাষ্প সরিয়ে ফেলার জন্য ওয়াট এর একটি “হাওয়া পাম্প” ও জুড়ে দিলেন। এর ফলে জ্বালানির খরচ তিন- চতুর্থাংশ কমে গেল। এই বায়ুশূন্য অবস্থা ঠিক রাখার জন্য আর ঘণীভূত বাষ্প সরিয়ে ফেলার জন্য ওয়াট এর একটি “হাওয়া পাম্প” ও জুড়ে দিলেন। এর ফলে জ্বালানির খরচ তিন চতুর্থাংশ কমে গেল। এই বায়ুশূন্য অবস্থা কোম্পানী এই জ্বালানি খরচ কমার ওপর এক-তৃতীয়াংশ স্বত্ত্ব বা “রয়্যালটি” দাবি করলেন। এই ইঞ্জিনের কার্যকারিতা এত গুণ বেড়ে গেল যে, আগে যে পরিমাণ পানি খনি থেকে বার করতে কয়েক মাস লেগে যেত, এখন সেই পানি মা্ত্র ১৭ দিনেই বার করে দেওয়া গেল।
এরপরে ওয়াট উন্নতর জীবনের ইঞ্জিন তৈরি করতে উদ্যোগী হলেন এই-ধরনের ইঞ্জিনেই বাষ্পের ক্ষমতা পূর্ণ সদ্ব্যবহার করার সুযোগ হল। বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের সাহায্যে ভারি যন্ত্রপাতি চালাতে গেলে ঐ ইঞ্জিনে কোন কিছু ঘোরানোর বন্দোবস্ত রাখতে হবে। এই ঘোরানোয় গতি আনার সহজতম উপায় ছিল হাতল আর চাকার ব্যবহার করা। দাঁতওয়ালা চাকা, হাতল আর পিষ্টন লাগিয়ে, সিলিন্ডারের দুটি দিকের সঙ্গেই বয়লারের যোগসূত্র ঘটিয়ে রেগুলেটার বসিয়ে, বাষ্পচালিত ইঞ্জিনে একেবারে ভোজবাড়ির মত রূপান্তর ঘটালেন। জেমস ওয়াট এই ইঞ্জিনের কার্যকরী ক্ষমতা শক্তি আর গতির আমূল পরিবর্তন ও পরিবর্ধন এর সঙ্গে ইঞ্জিনে বাষ্পের চাপ ও পরিমাণ মাপার জন্য “ষ্টীম প্রেসারগেজ” ও লাগালেন। ডাক্তারের কাজে স্টেথোস্কোপ যে রকম গুরুত্বপূর্ণ, একজন ইঞ্জিনিয়ারের কাছে এই “স্টীম প্রেসার গেজ” ও তাই। বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের যে নকশা জেমস ওয়াট তিলে তিলে তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন, এখনো পর্যন্ত তাতে আর বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। দুটি ক্ষেত্রে অবশ্য ওয়াট কিছুতেই তাঁর
ইঞ্জিনকে আরো বেশি উন্নতর করে তুলতে রাজি হননি। এদের মধ্যে প্রথমটি হল ইঞ্জিনের বহুমুখী, “যৌগিক” প্রসারণ-যার ফলে বাষ্পের সাহায্যে ট্রেন চালানো সম্ভব হতঃ আর দ্বিতীয়টি হল খুব উঁচু চাপে বাষ্প ব্যবহার করা। বহুমুখী,“যৌগিক” প্রসারণ তিনি করতে চাননি, কারণ উনি ভেবেছিলেন, এতে তাঁর নিজের সংস্থার একচেটিয়া অধিকার নষ্ট হয়ে যাবে। আর উঁচু চাপে বাষ্প ব্যবহার করতে তিনি রাজি হননি বিস্ফোরণের সম্ভাবনার কথা ভেবে। তাঁর এই মনোভাবের ফলেই পরে রিচার্ড ট্রেভিথিক (১৭৭১-১৮৩৩) আর জর্জ স্টিফেনসন (১৭৮১-১৮৪৮) বাষ্পশক্তি চালিত রেলগাড়ি তৈরি করতে পেরেছিলেন, এবং তার ফলে স্থলপথে যাতায়াত খুবই দ্রুত হয়ে উঠেছিল। অবশ্য বাষ্পচালিত জাহাজের তৈরির ব্যাপারে ওয়াটের বেশ খানিকটা ভূমিকা ছিল। আমেরিকার বাষ্পচালিত জাহাজের প্রথম নির্মাণকারী রবার্ট ফুলটন ওয়াটের কারখানাতেই তাঁর জাহাজের ইঞ্জিনের জন্য অর্ডার দিয়েছিলেন।
ওয়াটের শেষ জীবন কিছুটা করুণ। চৌষট্টি বছর বয়সে ব্যবসাপত্রের ঝামেলা ঝঞ্ঝাট থেকে সরে এসে তিনি নতুন আবিষ্কার করার কাজেই পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করলেন। সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে যে ব্যক্তিটির এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, সেই ব্যক্তিটি তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে নানারকম তুচ্চ যন্ত্রপাতি নিয়ে টুকটাক করায় মেতে উঠলেন। তাঁর শেষ আবিষ্কারটি ছিল ভাস্কর্যের কাজ নকল করার একটি যন্ত্র। একটি নির্দেশক বা “পয়েন্টার” ভাস্কর্যর ওপরে ঘুরে বেড়াত এবং তার নিয়ন্ত্রণে একটি ঘুরন্ত যন্ত্র অন্য একটি পাথরের চাইয়ের ওপর একইরকমভাবে খোদাই করে যেত। মৃত্যুর কিছুদিন আগেই এরকম একটি ভাস্কর্যের নকল তাঁর বন্ধুদেরকে “৮৩ বছরের এক তরুণ শিল্পীর” উপহারস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন।
১৮১৯ সালে ৮৩ বছর তিনি মারা যান। ওয়েষ্ট মিনিষ্টার অ্যাবিতে তাঁর স্মৃতিফলক রাখা আছে। স্যাভেরি এবং নিউকোমনে অগ্রদুত হলেও ওয়াইট বর্তমান যুগের আধুনিক বাষ্পচালিত যন্ত্রের আসল উদ্ভাবক ও সৃষ্টিকর্তা। বাষ্পের যে অসীম শক্তি আজ মানুষের করায়ত্ব, তার প্রধান অগ্রদূত জেমস ওয়াট। বাষ্পচালিত রেল ইঞ্জিনের জনক ট্রেভিথিক ও স্টিফেনসনকেও তিনিই পথ দেখিয়েছেন।
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.