এড্যলফ হিটলার

এড্যলফ হিটলার
[১৮৮৯-১৯৪৫]

হিটলারের জন্ম ১৮৮৯ সালের ২০এপ্রিল অষ্ট্রিয়া ব্যাভেরিয়ার মাঝামাঝি ব্রনাউ নামে এক আধা গ্রাম আধা শহর। বাবা একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে সামান্য চাকরি করত। যা আয় করত তার তিন পত্নী আর তাদের ছেলেমেয়েদের দু বেলা খাবার সংকুলানই হত না। হিটলার ছিলেন তার বাবার তৃতীয় স্ত্রীর তৃতীয় সন্তান। ছয় বছর বয়সে স্থানীয় অবৈতনিক স্কুলে ভর্তি হলেন।
ছেলেবেলা থেকেই হিটলার ছিলেন একগুয়ে, জেদী আর রগচটা। সামান্য ব্যাপারেই রেগে উঠতেন। অকারণে শিক্ষকদের সঙ্গে তক করতেন। পড়াশুনাতে যে তার মেধা ছিল না এমন নয়। কিন্তু পড়াশুনার চেয়ে তাকে বেশি আকৃষ্ট করত ছবি আঁকা। যখনই সময় পেতেন কাগজ পেন্সিল নিয়ে ছবি আঁকতেন।
এগারো বছর বয়সে ঠিক করলেন, আর পড়াশুনা নয়, এবার পুরোপুরি ছবি আঁকতেই মনোযোগী হবেন। বাবার ইচ্ছা ছিল স্কুলের পড়াশুনা শেষ করে কোন কাজকম জুটিয়ে নেবে। বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধেরই স্কুল ছেড়ে দিলেন হিটলার। স্থানীয় এক আট স্কুলে ভর্তির চেষ্টা কররেন। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হতে পারলেন না। একটা বেসরকারী স্কুলে ভর্তি হলেন। কিন্তু কয়েক মাস পর অর্থের অভাবে স্কুল ছেড়ে দিলেন।

মা মারা গেলে সংসারের সব বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল। ভাগ্য অন্বেষণে বেরিয়ে পড়লেন হিটলার্ ভিয়েনাতে চলে এলেন। ভিয়েনাতে এসে তিনি প্রথমে মজুরের কাজ করতেন। কখনো মাল বইতেন। এর পর রং বিক্রি করতে আরম্ভ করলেন। ভিয়েনাতে থাকার সময়েই তার মনের মধ্যে প্রথম জেগে ওঠে ইহুদী বিদ্বেষ। তখন র্জামানীর অধিকাংশ কলকারখানা, সংবাদপত্রের মালিক ছিল ইহুদীরা। দেশের অথর্নীতির অনেকখানিই তারা নিয়ন্ত্রণ করত। হিটলার কিছুতেই মানতে পারছিলেন না, জার্মান দেশে বসে ইহুদীরা জার্মানদের উপরে প্রভুত্ব করবে।
১৯১২ সালে তিনি ভিয়েনা ছেড়ে এলেন মিউনিখে। সেই দুঃখ-কষ্ট আর বেচে থাকবার সংগ্রামে আরো দুটো বছর কেটে গেল। ১৯১৪ সালে শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। হিটলার সৈনিক হিসাবে যুদ্ধে যোগ দিলেন। এই যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিলেও কোন পদোন্নতি হয়নি।
যুদ্ধ শেষ হল। দেশ জুড়ে দেখা দিল হাহাকার আর বিশৃঙ্খলা। তার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল বিভিন্ন বিপ্লবী দল, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এদের উপর গোয়েন্দাগিরি করবার জন্য হিটলারকে নিয়োগ করলেন কর্তৃপক্ষ।
সেই সময় প্রধান রাজনৈতিক দল ছিল লেবার পার্টি। তিনি সেই পার্টির সদস্য হলেন। অল্পদিনেই পাকপপাকিভাবে পার্টিতে নিজের স্থান করে নিলেন হিটলার। এক বছরের মধ্যেই তিনি হলেন পার্টি প্রদান। দলের নতুন নাম রাখা হল ন্যাশ্যনাল ওর্য়ার্কাস পার্টি। পরবর্তীকালে এই দলকেই বলা হত ন্যাৎসী পার্টি।
১৯২০ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি প্রথম ন্যাৎসী দলের সভা ডাকা হল। এতেই হিটলার প্রকাশ করলেন তাঁর পঁচিশ দফা দাবি।
এর পর হিটলার প্রকাশ করলেন স্বস্কতকা চিহৃযুক্ত দলের পতাকা। ক্রমশই ন্যাৎসী দলের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তিন বছরের মধ্যেই দলের সদস্য হল প্রায় ৫৬০০০। এবং এই জার্মান রাজনীতিতে এক গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা গ্রহন করল।
হিটলার চেয়েছিলেন মিউনিখে অন্য কোন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব যেন না থাকে। এই সময় তার পরিকল্পিত এক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ব্যথ হল। পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। তাখে এক বছরের জন্য ল্যান্ডসবার্গের পূরনো দুর্গে বন্দী করে রাখা হল।
জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আবার রাজনৈতিক কাজে ঝাপিয়ে পড়লেন। তার উগ্র স্পষ্ট মতবাদ, বলিষ্ঠ বক্তব্য জার্মানদের আকৃষ্ট করল। দলে দলে যুবকরা তার দলের সদস্য হতে আরম্ভ করল। সমস্ত দেশে জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠলেন হিটলার।
১৯৩৩ সালের নির্বাচন বিপুল ভোট পেলেন কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন না। পার্লামেন্টের ৬৪৭টির মধ্যে তার দলের আসন ছিল ২৮৮। বুঝতে পারলেন ক্ষমতা – অজন করতে গেলে অন্য পথ ধরে অগ্রসর হতে হবে।
কোন দল সংখ্যাগরিষ্ঠ না হওয়ার হিটলার পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিলেন। এইবার ক্ষমতা দখলের জন্য শুরু হল তার ঘৃণ্য রাজনৈতিক চক্রান্ত। বিরোধীদের অনেকেই খুন হলেন। অনেকে মিথ্যা অভিযোগে জেলে গেল। বিরোধী দলের মধ্যে নিজের দলের লোক প্রবেশ করিয়ে দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করলেন। অল্পদিনের মধ্যেই বিরোধী পক্ষকে প্রায় নিশ্চিহৃ করে দিয়ে হিটলার হয়ে উঠলেন শুধু ন্যাৎসী দলের নয়, সমস্ত জার্মানির ভাগ্যবিধাতা।
হিটলারের এই উহ্থানের পেছনে গুরুত্বপূণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল ইহুদীদের বিরুদ্ধে তার প্রচার। তিনিই জার্মানদের মধ্যে ইহুদী বিদ্বেষের বীজকে রোপণ করেছিরেন। দেশ থেকে ইহুদী বিতাড়নই ছিল তার ন্যাৎসী বাহিনীর প্রধান উদ্দেশ্য।
দেশে প্রান্তে প্রান্তে ইহুদী বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। শুরু হল তাদের উপর লুঠতরাজ হত্যা। হিটলার চেয়েছিলেন এইভাবে ইহুদীদের দেশ থেকে বিতাড়ন করবেন। কিন্তু কোন মানুষই সহজে নিজের আশ্রয়স্থল ত্যাগ করতে চায় না।
১৯৩৫ সালে নতুন আইন চালু করলেন হিটলার। তাতে দেশের নাগরিকদের দুটি ভাগে ভাগ করা হল, জেণ্টিল আর জু। জেণ্টিল অর্থাৎ জার্মান, তারাই খাটি আয, জু হল ইহুদীরা। তারা শুধুমাত্র জার্মান দেশের বসবাসকারী, এদেশের নাগরিক নয়। প্রয়োজনে তাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। দেশ জুড়ে জার্মানদের মধ্যে গড়ে তোলা হল তীব্র ইহুদী বিদ্বেষী মনোভাব।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর ইউরোপের মিত্রপক্ষ ও জার্মানদের মধ্যে যে ভার্সাই চুক্তি হয়েছিল তাতে প্রকৃতপক্ষে জার্মানির সমস্ত ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছিল। ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় আসবার পর থেকেই জার্মানির হৃত গৌরব পুনরুদ্ধর করবার সংকল্প গ্রহণ করেন। এবং তিনি একে একে ভার্সাই চুক্তি শতগুলি মানতে অস্বীকার করে নিজের শক্তি ক্ষমতা বিস্তারে মনোযোগী হয়ে ওঠেন।
১৯৩৪ সালে হিটলার রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে নিজেকে জার্মানির ফুয়েরার হিসাবে ঘোষণা করেন। এবং অল্পদিনের মধ্যে নিজেকে দেশের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তার এই সাফাল্যের মূলে ছিল জনগণকে উদ্দাপিত করবার ক্ষমতা।তিনি দেমের প্রান্তে প্রান্তে ঘুরে ঘুরে জনগণের কাছে বলতেন ভয়াবহ বেকারত্বের কথা, দারিদ্র্যের কথা, নানান অভাব-অভিযোগের কথা।
হিটলার তার সমস্ত ক্ষমতা নিয়োগ করলেন দেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে। তার সহযোগী হলেন কয়েকজন সুদক্ষ সেনানায়ক এবং প্রচারবিদ। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত প্রদেশে বিশাল সৈন্য সমাবেশ করলেন। কিছুদিনেই মধ্যেই সন্ধির চুক্তি ভঙ্গ করে রিইনল্যান্ড অধিকার করলেন। অষ্ট্রিযা ও ইতালি ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হল জার্মানির সাথে।
ইতালির সর্বাধিনায়ক ছিলেন মুসোলিনী। একদিকে ইতালির ফ্যাসীবাদী শক্তি অন্যদিকে ন্যাৎসী জার্মানি। বিশ্বজয়ের আকাঙ্ক্ষায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। ইতালি প্রথম আলবেনিয়া ও পরে ইথিওপিয়ার বেশ কিছু অংশ দখল করে নেয়।
ইউরোপ জুড়ে যখন যুদ্ধ চলছে, এশিয়ার জাপান জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিল। তারা ৭ই ডিসেম্বর ১৯৪২ সালে আমেরিকার র্পাল হারবার বন্দরের উপর বোমা বষণ করে বিধ্বস্ত করে ফেলল। এই ঘটনায় আমেরিকাও প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল।
প্রথম দিকে জার্মান বাহিনী সবর্ত্র জয়লাভ করলেও মিত্রশক্তি যখন সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ আরম্ভ করল, হিটলারের বাহিনী পিছু হটতে আরম্ভ করল। আফ্রিকায় ইংরেজ সেনাপতি মন্ট গোমারি রোমেলকে পরাজিত করলেন। এক বছরের মধ্যেই আফ্রিকা থেকে জার্মান বাহিনীকে বিতাড়িত করা হল। ইতালিতে মুসোলিনীকে বন্দী করা হল। ফ্যাসিবিরোধী জনগণ তাকে প্রকাশ্য রাস্তায় হত্যা করল।
জার্মান বাহিনীর সবচেয়ে বড় পরাজয় হল রাশিয়ার ষ্টালিনগ্রাদে। র্দীঘ ছয় মাস যুদ্ধের পর লাল ফৌজের কাছে আত্মসমপণ করতে বাধ্যহল জার্মান বাহিনী।
১৯৪৪ সালে লাল ফৌজ স্বদেশভূমি থেকে জার্মান বাহিনীকে সর্ম্পূণ উৎখাত করে একের পর এক অধিকৃত পোল্যান্ড, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরী, চেকোশ্লোভাকিয়া মুক্ত করতে করতে জার্মান ভূখন্ডে এসে প্রবেশ করে। অন্যদিকে ইংরেজ আর আমেরিকান সৈন্যরাও জার্মানীর অভিমুখে এগিয়ে চলে।
যতই চারদিক থেকে পরাজয়ের সংবাদ আসতে থাকে, হিটলার উন্মত্তের মত হয়ে ওঠেন। ১৯৪৫ সালের ২৯শে এপ্রিল হিটরারের শেষ ভরসা তার ষ্টেইনের সৈন্যবাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তার অধিকাংশ সঙ্গীই তাকে পরিত্যাগ করে মিত্রপক্ষের কাছে আত্মসমপর্ণের প্রস্তাব পাঠায়। হিটলার বুঝতে পারেন তার সব স্বপ্ন চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গিয়েছে। বার্লিনের প্রান্তে রুশ বাহিনীর কামানের গজন শোনা যাচ্ছে। হিটলার তার বারো বছরের সঙ্গিনী ইভাকে বার্লিন ছেড়ে পালিয়ে যাবার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইভা তাকে পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। দুজনে সেই দিনই বিয়ে করেন।
বিয়ের পর হিটলার উপস্থিত সঙ্গীদের সাথে একসঙ্গে শ্যাম্পেন পান করলেন। তারপর দুটি চিঠি লিখলেন।একটি চিঠিতে সব কিছুর জন্য ইহুদীদের অভিযুক্ত করলেন। অন্য চিঠিতে নিজের সব সম্পত্তি পার্টিকে দান করে গেলেন।
৩০শে এপ্রিল ১৯৪৫। চারদিকে থেকে বার্লিন অবরোধ করে ফেলে লাল ফৌজ। হিটলার বুঝতে পারেন আর অপেক্ষা করা উচিত নয়। যে কোন মুহূর্তে লাল ফৌজ এসে তাকে বন্ধী করতে পারে। তিনি তার ড্রাইভার ও আরো একজনকে বললেন, মৃত্যুর পর যেন তাদের এমনভাবে পোড়ানো হয়, দেহের কোন অংশ যেন অবশিষ্ট না থাকে।
বিকেল সাড়ে তিনটের সময় তিনি নিজের ঘর থেকে বার হয়ে তার পার্শ্বচরদের সাথে করমদন করে নিজের ঘরে ঢুকলেন। তারপিই গুলির শব্দ শোনা গেল। হিটলার নিজের মুখের মধ্যে গুলি করে আত্মহত্যা করলেন। আর ইভা আগেই বিষ খেয়েছেন।
দুজন সৈন্য তাদের কম্বল দিয়ে মুড়ে বাগানে নিয়ে এল। চারদিকে থেকে কামানোর গোলা এসে পড়ছে। সেই অবস্থাতেই মৃতদেহের উপর পেট্রল ঢেকে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল। যিনি সমস্ত মানবজাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন, নিজের অপরিণাম-দর্শিতায় শেষ পযর্ন্ত নিজেই ধ্বংস হয়ে গেলেন।

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.

[blogger]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget