মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী (রঃ)

মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী (রঃ)
(১২০৭-১২৭৩ খ্রিঃ)

আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক কি? আল্লাহকে চেনা ও বুঝার উপায় কি? মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক কি? ইহজগতে থেকে মানবাকৃতি বজায় রেখে মানুষ কিভাবে অস্তিত্বহীন হতে পারে? নিয়তি ও কর্মের সমস্যার সমাধান কি? নফস কি এবং নফসের প্রভার থেকে মানুষের মুক্তি লাভের উপায় কি? এ সকল বিস্ময়কর প্রশ্নের জবাব যিনি প্রথম মানুষের সামনে ‍দিয়েছিলেন, তাঁর নাম মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (রঃ)।
৬০৪ হিজরীর ৬ রবিউল আউয়াল মোতাবেক ১২০৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ সেপ্টম্বর এ মহামনীষী বর্তমান আফগানিস্তানের বলখ নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল বাহাউদ্দিন ওয়ালিদ। পিতা ছিলেন তৎকালের স্বনামখ্যাত কবি ও দরবেশ। জানা যায় ‍পিতা বাহাউদ্দিন ওয়ালিদের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে পারস্যের রুম প্রদেশের অন্তর্গত ‘কুনিয়া’র তৎকালীন শাসনকর্তা আলাউদ্দিন কায়কোবাদ মনীষী বাহাউদ্দিন কুনিয়ায় আমন্ত্রণ করে পাঠান। আমন্ত্রণ পেয়ে বাহাউদ্দিন ওয়ালিদ সপরিবারে কুনিয়ার চলে যান এবং রাজনৈতিক কারণে তিনি সেখানে বাসস্থান নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এ রুম প্রদেশের নাম অনুসারে ‍তিনি ‘রুমী’ নামে খ্যাতি লাভ করেন।
৫ বছর বয়স থেকেই মাওলানা রুমী (রঃ) এর মধ্যে বিভিন্ন আলৌকিক বিষয়াদি পরিলক্ষিত হতে থাকে। বাল্যকালে তিনি অন্যান্য ছেলেমেয়েদের ন্যায় খেলাধূলা ও আমোদ প্রমোদ লিপ্ত থাকতে পছন্দ করতেন না। তিনি সর্বদা ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক আলোচনা পছন্দ করতেন। ৬ বছর বয়স থেকেই ‍তিনি রোজা রাখতে শুরু করেন। ৭ বছর বয়সে তিনি সুমধুর কণ্ঠে পবিত্র কোরআন বিশুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করতেন।কোরআন তেলায়াদের সময় তাঁর দু’নয়নে অশ্রুধারা প্রবাহিত হত। সম্ভবত এ বয়সেই তিনি কোরআনের মর্মবাণী ও আধ্যাত্মিক বিষয়াদি অনুধাবন করতে পারতেন। কথিত আছে মাওলানা রুমী (রঃ) এর বয়স যখন ৬ বছর তখন পিতা বাহাউদ্দিন বালক (রঃ) কে সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ইরানের নিশাপুরে যান এবং সেখানে বিখ্যাত দার্শনিক ও কবি শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তাবের সাক্ষাৎ লাভ করেন। শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তাব বালক জালাল উদ্দিনের মুখচ্ছবি দেখেই তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যত বুঝতে পেরে তাঁর জন্যে দোয়া করেন এবং তাঁর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা জন্যে পিতাকে উপদেশ দেন। নিশাপুর ত্যাগ করে পিতা বাহাউদ্দিন রুমী (রঃ) কে সঙ্গে নিয়ে পবিত্র হজ্জ সম্পাদন করেন এবং বাগদাদসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। পিতা নিজেই তাঁর পুত্রকে আথ্যাত্মিক জ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতে লাগলেন। শিক্ষা লাভের প্রতি তাঁর ছিল পরম আগ্রহ।
১২৩১ সালে পিতার মৃত্যুর পর মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (রঃ) মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন এবং জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে মারাত্মক বাধাঁ এসে দাঁড়ায়। মাতাকে হারিয়ে ছিলেন আরো কয়েক বছর পূর্বে। এ সময়ে কুনিয়া শহরে তিনি সাহচর্য লাভ করেন পিতার প্রধান শিষ্য তৎকালীন পন্ডিত ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী সৈয়দ বোরহান উদ্দিনের। সৈয়দ বোরহান উদ্দিন পিতৃ শোকাকুল মাওলানা রুমী (রঃ) কে শিক্ষা দান করেন। এরপর উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্যে তিনি চলে যান প্রথমে সিরিয়া ও পরে দামেস্কে। তিনি দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৭ বছর অধ্যয়ন করেন। এছাড়া জ্ঞানের সন্ধানে তিনি ৪০ বৎসর বয়স পর্যন্ত ঘুরে বেড়ান দেশ থেকে দেশান্তরে। তিনি তাঁর শিক্ষা জীবনে তৎকালীন যুগ শ্রেষ্ঠ মনীষীদের সাহচর্য লাভ করেন। তিনি যাদের থেকে জ্ঞান লাভ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে শামসুদ্দিন তাব্রীজ (রঃ), ইবনে আল আরাবি (রঃ), সালাউদ্দিন ও হুসামউদ্দিন এর নাম উল্লেখযোগ্য। জালাল রুমী (রঃ) এত জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন যে, তৎকালীন সময়ে তাঁর সাথে অন্য কারো তুলনা ছিল না। কথিত আছে ১২৫৯ সালে চেঙ্গীস খানের পৌত্র হালাকু খান যখন বাগদাদ অধিকার করে তদীয় সেনাপতি কুতববেগকে দামেস্কের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন তখন দামেস্কবাসীদেরকে সহযোগিতা করার জন্যে ধ্যানযোগে তিনি দামেস্কে উপস্থিত হয়েছিলেন।
পিতার মৃত্যুর পর রুমী (রঃ) পিতার গদীনেশীন হন। বিভিন্ন দেশ থেকে তাঁর নিকট আগত হাজার হাজার লোকদেরকে তিনি শিক্ষাদান করেন। তিনি বহু কিতার লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর গ্রন্থাবলীর মধ্যে ‘মসনবী’ ও ‘‍দিওয়ান’ তাঁকে অমর করে রেখেছে। বাংলা ভাষা সহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তাঁর গ্রন্থ ‘মসনবী’ অনূদিত হয়েছে। আলেমগণ আজও বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল ও ধর্মীয় আলোচনা সভায় তাঁর রচিত কবিতা আবৃত্তি করে শ্রোতামন্ডলীকে আকৃষ্ট করে থাকেন। পারস্যে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের পরই ‘মসনবী’ কে যথার্থ পথ প্রদর্শক বলে মনে করা হয়। ‘দিওয়ানে’ রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার শ্লোক, যার প্রায় সমস্তই আধ্যাত্মিক গজল। তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য ও সংস্কৃতি অতুলনীয়। ‘ইলমে মারেফত’ ও  ‘এলমে লাদুনিতে’ তিনি অসাধারণ পান্ডিত্য লাভ করেছিলেন। এটা হলো শ্রেষ্ঠ জ্ঞানের আলয়। সুফীর মতে দেহই মানবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনের মহা অন্তরায়। দেহের ভিতরে যে কামনা ও বাসনা মানুষকে সর্বদা সত্যপথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, যা মানুষকে ব্যক্তিত্ব বা অহংকার প্রদান করে ভোগলিপ্সু করে, সে জৈব আকাংখার নাম সুফীদের ভাষায় ‘নফর’। নফসের ধ্বংসই দেহের কর্তৃত্বের অবসান ও আত্মার স্বাধীনতার পূর্ণতা। তাই নফসের বিরুদ্ধে সুফীদের আজীবন সংগ্রাম। রুমী (রঃ) তাঁর সারাটা জীবন নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। রুমীর মতে বুদ্ধি, যুক্তি ও ভক্তি এক নয়। বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে আল্লাহকে চিনা, বুঝা ও পাওয়া যায় না। বরং এর জন্যে প্রয়োজন বিশ্বাস ও ভক্তি। ভক্তিই সোপান। আর ভক্তির উৎস হচ্ছে প্রেম ও আসক্তি। রুমীর মতে আল্লাহ নির্পুণ নন। জ্ঞান, বুদ্ধি ও যুক্তির মাপকাঠি দিয়ে আল্লাহর গুণাবলী অনুধাবন করতে পারে না। কারণ বুদ্ধি ও যুক্তি নিজেই একটি সৃষ্ট বস্তু এবং মস্তিস্ক ও স্নায়ুমন্ডলীর সক্রিয়তার উপর নির্ভরশীল। সুতরাং সৃষ্ট দিয়ে অসৃষ্টকে বুঝা সম্ভব নয়। আল্লাহকে বুঝতে ও চিনতে হলে ভক্তি ও বিশ্বাসের প্রয়োজন। তাহলেই অন্তর দিয়ে আল্লাহকে অনুধাবন করতে পারবে। মানুষ যখন মা’রেফাতের ঊর্ধ্বতন স্তরে উন্নীত হয়ে আপনার ভিতর আল্লাহর প্রকাশ অনুভব করে তখন তাঁর ব্যক্তিত্বের সীমা কোথায় ভাসিয়ে যায়। তিনি তখন অসীমের ভিতর আপনাকে হারিয়ে ফেলেন। কিংবা তিনি নিজের সীমার ভিতরই অসীমের সন্ধান লাভ করেন। তখন তিনি আনন্দে বিভোর হয়ে বিশ্ব ভ্রহ্মান্ডের রাজৈশ্বর্যকে একেবারেই তুচ্ছ বোধ করেন। মারেফাতের স্তর উন্নীত হলে আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে আর কোন ভেদাভেদ থাকে না। এ অবস্থার নাম হলো ‘হাল’। এ কথাগুলো পৃথিবীর মানুষের সামনে অস্তিত্বহীন হতে পারে তা মাওলানা রুমী (রঃ)। ইহজগতে থেকে মানবাকৃতি বজায় রেখে মানুষ কিভাবে অস্তিত্বহীন হতে পারে তা মাওলানা রুমী (রঃ) দেখিয়েছেন।
মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী (রঃ) ‘ভাগ্য ও পুরস্কার’ সমস্যার সহজ সমাধান দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের সকল কার্যের নিয়ন্তা আল্লাহ। কিন্তু এর সংগে তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে, আল্লাহ পাক মানুষকে কতকগুলো কার্যের পূর্ণ স্বাধীনতা বা স্বেচ্ছাধিকার দিয়েছেন, যার সীমারেখার মধ্যে মানুষ নিজেই তার কর্মপন্থা নির্বাচনের অধিকারী। এ সকল কার্যাদির কর্মফলের জন্যে মানুষ নিজেই দায়ী। কারণ এগুলো করা না করা তারই স্বেচ্ছাধিকার ভুক্ত, যদিও কর্ম করার শক্তি আল্লাহই মানুষকে প্রদান করেছেন। রুমী (রঃ) ছিলেন তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী।
রুমী (রঃ) খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তিনি দুনিয়ার ভোগ বিলাস ও ঐশ্বর্যকে তুচ্ছ মনে করতেন। তিনি যে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন সে তুলনায় দুনিয়া তুচ্ছ হওয়াটাই স্বাভাবিক। মৃত্যুকালে তাঁর কোন সঞ্চিত ধন-সম্পদ ছিল না। ৬৬ বছর বয়সে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর অসুস্থতার সংবাদ প্রচারিত হবার সাথে সাথে চতুদিক হতে হাজার হাজার লোক গভীর উদ্বেগের সাথে ছুটে আসে। তৎকালীন বিখ্যাত চিকিৎসক শেখ সদরউদ্দিন, আকমাল উদ্দিন ও গজনফার তাঁর চিকিৎসা করে ব্যর্থ হন। এ সময় রুমী (রঃ) চিকিৎসক শেখ সদরউদ্দিন সাহেবকে লক্ষ্য করে বললেন, “আশেক ও মাশুকের মধ্যে একটি মাত্র পর্দার ব্যবধান রয়েছে। আশেক চাচ্ছে তার মাশুকের নিকট চলে যেতে। পর্দাটা যেন দ্রুত উঠে যায়।”শেখ সদরউদ্দিন বুঝতে পেরেছিলেন, রুমী (রঃ) এর আয়ু শেষ হয়ে আসছে; অর্থাৎ রুমী (রঃ) আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাওয়ার জন্য তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এরপর তিনি তাঁর শিষ্যদের সান্ত্বনা দিয়ে কিছু উপদেশ দিলেন, যার কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
ইন্দ্রিয় লালসাকে কখনো প্রশ্রয় দিবে না। পাপকে সর্বদা পরিহার করবে। নামাজ ও রোজা কখনো কাযা করবে না। অন্তরে ও বাহিরে সর্বদা আল্লাহকে ভয় করে চলবে। বিপদে ধৈর্য্যধারণ করবে। বিদ্রোহ ও প্রতিশোধমূলক মনোভাব পোষণ করবে না। নিদ্রা ও কথাবার্তায় সাধ্যানুযায়ী সংযমী হবে। কাউকে কোন প্রকার কষ্ট দিবে না। সব সময় সৎ লোকদের সংস্পর্শে থাকবে। মনে রাখবে, মানুষের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ, যার দ্বারা দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধিত হয়। তারপর তিনি বললেন, মানুষের দেহ নশ্বর কিন্তু তার আত্মা অবিনশ্বর। এ নশ্বর দেহ ধ্বংস প্রাপ্ত হয় বটে; কিন্তু তার ভিতর যে অবিনশ্বর আত্মা রয়েছে তা চিরকালই বেঁচে থাকে।
এরপর এ বিখ্যাত মনীষী ১২৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। এ সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর।

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.

[blogger]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget