টমাস আলভা এডিসন
[১৮৪৭-১৯৩১]
এডিসনের জন্ম ১৮৪৭ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি কানাডার মিলানে। তাঁর পিতা ছিলেন ওলন্দাজ বংশোদ্ভুত। কয়েক পুরুষ আগে এডিসন পরিবার হল্যান্ড ত্যাগ করে আমেরিকায় এসে আশ্রয় নেন। কিছুদিন পর তাঁরা আমেরিকা ত্যাগ করে কানাডায় এসে বসবাস শুরু করেন।এডিসনের পিতার আর্থিক সচ্ছলতার জন্য ছেলেবেলার দিনগুলি আনন্দেই কেটেছিল। সাত বছর বয়েসে এডিসনের পিতা মিচিগানের অন্তর্গত পোর্ট হারান নামে একটা শহরে নতুন করে বসবাস শুরু করলেন।
এখানে এসেই স্কুলে ভর্তি হলেন এডিসন। ছেলেবেলা থেকেই অসম্ভব মেধাবী ছিলেন তিনি। কিন্তু স্কুলের বাঁধা পাঠ্যসূচী তাঁর কাছে খুব ক্লান্তিকর মনে হত। তাই ক্লাসে ছিলেন সকলের পেছনের ছাত্র। ক্লাসে ছিলেন সকলের পেছনের ছাত্র। ক্লাসে বসে খোলা জানলা দিয়ে বাইরের মুক্ত প্রকৃতির দিকে চেয়ে থাকতে প্রায়ই আনমনা হয়ে যেতেন। শিক্ষকরা অভিযোগ করতেন, এ ছেলের প্রতি পড়াশুনায় কোন মন নেই। শিক্ষকদের কথা শুনে মনে হত এই ছেলে একদিন বিখ্যাত হবেই। স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনলেন এডিসনকে। শেষ হল এডিসনের তিন মাসের স্কুল জীবন। এর পরবর্তীকালে আর কোনদিন স্কুলে যাননি। এডিসন মায়ের কাছেই শুরু হল তাঁর পড়াশুনা।
ছেলেবেলা থেকেই এডিসনের ঝোঁক ছিল পারিপার্শ্বিক যা কিছু আছে, যা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হয়, তা নিয়ে ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বার করতে পারেন কিনা দেখবার জন্য ঘরের এক কোণে ডিম সাজিয়ে বসে পড়লেন। কয়েক বছর পর কিশোর এডিসন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবার জন্য একটা ছোট ল্যাবরেটরি তৈরি করে ফেললেন তাঁর বাড়ির নিজের তলার একটা ঘরে। ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি বলতে ছিল কিছু ভাঙা বাক্স, কিছু শিশি বোতল, ফেলে দেওয়া কিছু লোহার তার, আর এখান-ওখান থেকে কুড়িয়ে আনা যন্ত্রপাতির টুকরো। অল্প কিছুদিন যেতেই তিনি বুঝতে পারলেন হাতে-কলমে পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন যন্ত্রপাতি আর নানান জিনিসপত্রের। বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অর্থ ছাড়া তো কোন পরীক্ষার কাজই চালানো সম্ভব নয়। এডিসন স্থির করলেন তিনি কাজ করে অর্থ সংগ্রহ করবেন। তেরো বছরের ছেলে চাকরি করবে! বাবা-মা দুজনেই তো অবাক। কিন্তু এডিসন জেদ ধরে রইলেন, একগুঁয়ে ছেলে একবার যা স্থির করবে কোনভাবেই তার নড়াচড়া হবে না। অগত্যা মত দিতে হল এডিসনের বাবা-মাকে। কিন্তু তেরো বছরের ছেলেকে কাজ দেবে কে? অনেক খোঁজাখুঁজির পর খবরের কাগজ ফেরি করার কাজ পাওয়া গেল। ট্রেনে পোর্ট হুরোন স্টেশন থেকে ড্রেট্রয়েট স্টেশনের মধ্যে যাত্রীদের কাছে খবরের কাগজ বিক্রি করতে হবে। বিক্রির উপর কমিশন। আরো কিছু বেশি আয় করবার জন্য এডিসন খবরের কাগজের সাতে চকলেট বাদামও রেখে দিতেন। কয়েক মাসের মধ্যেই বেশ কিছু অর্থ সংগ্রহ করে ফেললেন।
এই সময় এডিসন সংবাদ পেলেন একটি ছোট ছাপাখানা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। সামান্য যে অর্থ জমিয়েছিলেন তাই দিয়ে ছাপাখানা্র যন্ত্রপাতি কিনে ফেললেন, এবার নিজেই একটি পত্রিকা বার করে ফেললেন। সংবাদ জোগাড় করা, সম্পাদনা করা, ছাপানো, বিক্রি করা, সমস্ত কাজ তিনি একাই করতেন। অল্পদিনেই তাঁর কাগজের বিক্রির সংখ্যা বেড়ে গেল। এক বছরের মধ্যে তাঁর লাভ হল একশো ডলার। তখন তাঁর বয়েস পনেরো বছর।
দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর তৈরি হল কার্বন ফিলামেন্ট। এডিসন নিজেই লিখেছেন সেই চমকপ্রদ কাহিনী। “ফিলামেন্ট তৈরি হওয়ার পর তাকে কাচ তৈরির কারখানায় নিয়ে যেতে হবে। ব্যচিলবের (এডিননের এক সহকর্মী) হাতে কার্বনের ফিলামেন্ট। পেছনে আমি। এমনভাবে দুজনে চলেছি মনে হচ্ছে যেন কোন ,মহামূল্যবান সম্পত্তি নিয়ে যাচ্ছি। কাচের কারখানায় সবেমাত্র পা দিয়েছি, সম্ভবত অতি সতর্কতার জন্যেই হাত থেকে ফিলামেন্টটি মাটিতে পড়ে দু-টুকরা হয়ে গেল। হতাশ মনে ল্যাবরেটরিতে ফিরে গেলাম। নতুন ফিলামেন্ট তৈরি করে আবার চললাম কাচ কারখানায়। কপাল মন্দ, এইবার এক স্বর্ণকারের হাতের স্ক্রু ড্রাইভার পড়ে ভেঙে টুকরো হয়ে গেল। আবার ফিরে গেলাম। রাত হবার আগেই নতুন একটা কার্বন দিয়ে এসে বাল্বের মধ্যে ঢোকালাম। বাল্বের মুখ বন্ধ করা হল, তারপর কারন্ট দেওয়া হল। মুহূর্তে চোখের সামনে জ্বলে উঠল বৈদ্যুতিক বাতি।”
প্রথম বৈদ্যুতিক বাতিটি প্রায় চল্লিশ ঘণ্টা জ্বলেছিল। দিনটা ছিল ২১শে অক্টোবর ১৮৭৯ সাল, এডিসন সেদিন কল্পনাও করতে পারেননি তাঁর সৃষ্ট আলো একদিন পৃথিবীর সমস্ত গৃহের অন্ধকার দূর করবে। প্রথমে তিনি শুধুমাত্র বাল্বের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। এরপর প্রয়োজন দেখা দিল সমগ্র বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতির সাধন করা। এডিসন নতুন এক ধরনের ডাইনামো তৈরি করলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার জেনারেটর থেকে শুরু করে ল্যাম্প তৈরি করা, পর্যন্ত তাকে জ্বালানোর উপায় বার করা সমস্তই তাঁর উদ্ভাবন। যখন নিউইয়র্কে প্রথম বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র গড়ে উঠল, এডিসন ছিলেন একাধারে তার সুপারিনটেন্ডন্ট, তার ফোরম্যান, এমনকি তার মজদুর। এত কাজের বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েও কখনো বিব্রত বোধ করতেন না। আসলে দিন-রাতের প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি কাজে লাগাতে চাইতেন। অকারণ বিশ্রাম, হাসি আমোদ সময় কাটাতে চাইতেন না।
একদিন একটি নিমন্ত্রিত বাড়িতে গিয়েছেন তিনি। গৃহকর্তা বিশেষ কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। লোকজনের ভিড়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন এডিসন। আর অপেক্ষা না করে ফিরে যাবার জন্য বাইরের দরজার সামনে আসতেই গৃহকর্তার সাথে সাক্ষাৎ হল। এডিসনকে দেখামাত্রই তিনি বললেন, “আপনি এসেছেন দেখে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। এখন আপনি কি নিয়ে কাজ করছেন?”
এডিসন সাথে সাথে বললেন, “কি করে আমি বার হতে পারি তাই নিয়ে।”
১৮৪৭ সালে এডিসন তাঁর বিখ্যাত মেনলো পার্ক ছেড়ে ওয়েস্ট অরেঞ্জে এলেন (West Orange)। এই সময় তিনি শব্দের গতির মত কিভাবে ছবির গতি আনা যায় তাই নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছিলেন। মাত্র দু’বছরের মধ্যে তিনি উদ্ভাবন করলেন ‘কিনেটোগ্রাফ’ যা গতিশীল ছবি তোলবার জন্য প্রথম ক্যামেরা। যখন আমেরিকাতে বাণিজ্যিকভাবে ছায়াছবি নির্মাণের কাজ শুরু করার ভাবনা-চিন্তা চলছিল তখন সিনেমার প্রয়োজনীয় সব কিছুই উদ্ভাবন করে ফেলেছেন এডিসন। প্রথম অবস্থায় সিনেমা ছিল নির্বাক। ১৯২২ সালে এডিসন আবিস্কার করলেন কিনেটোফোন যা সংযুক্ত করা হল সিনেমার ক্যামেরার সাথে। এরই ফলে তৈরি হল সবাক চিত্র। অতি সাধারণ জিনিস থেকে সিনেমা ক্যামেরার মত জটিল যন্ত্রের উদ্ভাবনের কথা ভাবলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়, কি অসাধারণ ছিল তাঁর প্রতিভা!
এডিসন তাঁর ছুটির দিনগুলি কাটাবার জন্য সুন্দর একটি বাড়ি তৈরি করেছিলেন। একদিন তাঁর বন্ধুবান্ধব আত্মীয় পরিজনদের সেই বাড়িতে এসে উপস্থিত হলে তাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবকিছু দেখালেন। বাড়ির বিভিন্ন কাজের সুবিধার জন্য যে সব যন্ত্রপাতি উদ্ভাসিত করেছেন তাও দেখাতে ভুললেন না। সকলেই মুগ্ধ, শুধু একজন অতিথি বললেন, “আপনার বাড়ির সবকিছুই ভাল শুধু বাড়িতে ঢোকবার গেটটা ভীষণ শক্ত। জোরে চাপ দিয়ে খুলতে হয়।”
এডিসন হাসতে হাসতে বললেন, “তোমরা যখন চাপ দিয়ে দরজা খুলছ তখন আট গ্যালন জল পাম্পে করে আমরা বাড়ির ছাদে ট্যাঙ্কে ভর্তি হচ্ছে।
মৃত্যুর কয়েকদিন আগে পর্যন্ত তিনি নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। প্রতিভায় বিশ্বাস করতেন না এডিসন, বলতেন, পরিশ্রমই হচ্ছে প্রতিভার মূল কথা। এই মহান কর্মবীর মানুষটি মৃত্যু হয় ১৯৩১ সালের ১৮ই অক্টোবর। তাঁর মৃত্যুর পর নিউইয়র্ক পত্রিকায় লেখা হয়, “মানুষের ইতিহাসে এডিসনের মাথার দাম সবচেয়ে বেশি। কারণ এমন সৃজনীশক্তি অন্য কোন মানুষের মধ্যে দেখা যায়নি।”
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.