কার্ল মার্কস

কার্ল মার্কস
(১৮১৮-১৮৮৩)

লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের বিশাল পাঠকক্ষের এক কোণে প্রতিদিন এসে পড়াশুনা করেন এক ভদ্রলোক । সুন্দর স্বাস্থ্য, চওড়া কপাল, সমস্ত মুখে কালো দাড়ি । দুই চোখে গভীর দীপ্তি । যতক্ষন চেয়ারে বসে থাকেন, টেবিলে রাখা স্তূপিকৃত বইয়ের মধ্যে আত্মমগ্ন হয়ে থাকেন । দিন শেষ হয়ে আসে । একে একে সকলে পাঠকক্ষ থেকে বিদায় নেয়, সকলের শেষে বেরিয়ে আসেন মানুষটি ।
ধীর পদক্ষেপে রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেন । একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে আসেন । ২৮ নম্বর ঘরের দরজায় এসে কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দেন এক ভদ্রমহিলা । সাথে সাথে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে ছঁটি ছেলেমেয়ে ।
এক এক দিন ঘরে এসে লক্ষ্য করেন শিশুদের বিষাদক্লিষ্ট মুখ । মানুষটির বুঝতে অসুবিধা হয় না ঘরে খাবার মত একটুকরো রুটিও নেই । আবার বেড়িয়ে পড়েন মানুষটি । চেনা পরিচিতদের কাছ থেকে সামান্য কিছু ধার করে খাবার কিনে নিয়ে আসেন, যেদিন কারোর কাছে ধার পান না সেদিন কোন জিনিস বন্ধক দেন । ঘরে ফিরে আসতেই সব কিছু ভুলে যান, তখন আবার সেই হাসিখুশিভরা প্রাণোচ্ছল মানুষ । গুরুগম্ভীর পান্ডিত্যের চিহ্নমাত্র নেই ।
এই অদ্ভুত মানুষটির নাম কার্ল মার্কস । যিনি রাজনীতি রাষ্ট্রনীতি সমাজনীতি অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রেই যুগান্তর এনেছেন । আধুনিক পৃথিবীকে উত্তরণ করেছেন এক যুগ থেকে আরেক যুগে ।
যিনি পৃথিবীর সমস্ত শোষিত বঞ্চিত দরিদ্র নিপীড়িত মানুষকে মুক্তির আলো দিয়েছেন । ভাগ্যের কি বিচিত্র পরিহাস, সেই মানুষটিকে কাটাতে হয়েছে চরম দারিদ্র্য আর অনাহারের মধ্যে ।
জার্মানির রাইন নদীর তীরে ছোট্ট শহর ট্রিয়ার (Trier) । এই শহরে বাস করতেন হার্সকেল ও হেনরিয়েটা মার্কস নামে এক ইহুদি দম্পতি, হার্সকেল ছিলেন আইন ব্যবসায়ী । শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত মার্জিত রুচির লোক বলে শহরে তাঁর সুনাম ছিল । প্রতিবেশী সকলেই তাঁকে সম্মান করত । প্রতিবেশী জার্মানদের সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক ছিল ।
১৮১৮ সালের ৫ মে হেনরিয়েটা তাঁর দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিলেন । প্রথম সন্তান ছিল মেয়ে । জন্মের পর শিশুর নাম রাখা হল কার্ল ।
যখন কার্লের বয়স ৬ বছর, হার্সকেল তার পরিবারের সব সদস্যই খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা নিলেন । ইহুদির উপর নির্যাতনের আশঙ্কায় ভীত হয়ে পড়েছিলেন হার্সকেল । সন্তানদের রক্ষার জন্য নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মান্তরিত হলেন ।
হার্সকেলের সব চেষ্টাই বৃথা গেল । যে সন্তানদের রক্ষার জন্য তিনি নিজের ধর্ম ছাড়লেন, তাঁর সেই সন্তানদের মধ্যে চারজন টিবিতে মারা গেল । শুধু বেঁচে রিইলেন কার্ল, হয়ত মানুষের প্রয়োজনের জন্যেই ইশ্বর তাঁকে বাঁচিয়ে রাখলেন । ছেলেবেলা থেকেই কার্ল মার্কস ছিলেন প্রতিবেশী অন্য সব শিশুদের চেয়ে আলাদা । ধীর শান্ত কিন্তু চরিত্রের মধ্যে ছিল এক অনমনীয় দৃঢ়তা । যা অন্যায় মনে করতেন, কখনোই তার সাথে আপোস করতেন না ।
বারো বছর বয়েসে কার্ল স্থানীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন । তিনি ছিলেন ক্লাসের সেরা ছাত্র । সাহিত্য গণিত ইতিহাস তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট  করত । স্কুলের ছাত্র অবস্থাতেই তিনি মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে বিচলিত হয়ে পড়তেন । সহপাঠীরা যখন বড় কিছু হবার স্বপ্ন দেখত, তাঁর মনে হত এই সব দুঃখী মানুষের সেবায় নিজের জীবনকে উৎসর্গ করবেন ।
সতেরো বছর বয়সে কৃতিত্বের সাথে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন ।  ভর্তি হলেন জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে । ইচ্ছা ছিল দর্শন নিয়ে পড়াশুনা করবেন । শুধুমাত্র বাবার ইচ্ছা পূর্ণ করতেই ভর্তি হলেন আইন পড়তে । কিন্তু আইনের বই –এর চেয়ে বেশি ভাল লাগত কবিতা, সাহিত্য, দর্শন । আর যাকে ভাল লাগত তার নাম জেনি । পুরো  নাম জোহান্না বার্থাজুলি জেনি ওস্টেফালেন । জেনির বাবা ট্রিয়ারের এক সম্ভ্রান্ত ব্যারন, রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা । ব্যারনের সাথে কার্লের বাবার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব । সেই সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল জেনি আর কার্লের । শৈশবে খেলার সাথী, যৌবনে নিজের অজান্তেই দুজনে প্র্রেমের বাঁধনে বাঁধা পড়ে গেল । যতদিন দুজনে ট্রিয়ারে ছিলেন, নিয়মিত দেখা হত কিন্তু বনে যেতেই কার্ল অনুভব করলেন জেনির বিরহ । পড়াশুনায় মন বসাতে পারেন না, সব সময় মনে পড়ে বেড়ান ।
ছেলের এই অস্থিরতার কথা শুনে বিচলিত হয়ে পড়লেন হার্সকেল । ডেকে পাঠালেন মার্কসকে, ট্রিয়ারে এসে পৌছতেই ফিরে পেলেন জেনিকে । আবার আগের মত স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন কার্ল । কিন্তু এখানে তো বেশিদিন থাকা সম্ভব হবে না । তাই গোপনে জেনি কার্লের বাগদত্তা হয়ে গেলেন । কিন্তু এ খবর গোপন রাখা গেল না । চিন্তায় পড়ে গেলেন হার্সকেল, সামনে গোটা ভবিষৎ পড়ে রয়েছে । ঠিক করলেন এবার বন নয়, কার্লকে পাঠাবেন বার্লিনে । সেখানে রয়েছেন অনেক জ্ঞানী-গুণী অধ্যাপক । সেখানকার পরিবেশে গেলে হয়ত কার্লের পরিবর্তন হতে পারে ।
বাদ সাধলেন কার্ল । বার্লিনে গেলে শুধু আইন পড়ব না । দর্শন আর ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করব । অগত্যা তাতেই মত দিলেন হার্সকেল ।
বার্লিনের নতুন পরিবেশ ভাল লাগল কার্লের । পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত চিঠি লেখেন জেনিকে । সেই চিঠিতেই থাকে ছোট ছোট কবিতা, দাস ক্যাপিটালের স্রষ্টা প্রেমের কবিতা লিখছেন ।
বার্লিন থেকে মার্কস এলেন জেনাতে । এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে ডক্টরেট লাভ করলেন । তাঁর থিসিস –এর বিষয় ছিল “ The difference between the narural philosophy of demiocitus and Epicurus.” এই প্রবন্ধে তার প্রতিটি যুক্তি এত তথ্যপূর্ণ সুসংহত প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশ করেছেন, পরীক্ষকরা বিস্মিত হয়ে গেলেন ।
কিন্তু এই প্রবন্ধে তাঁর স্বাধীন বস্তুবাদী মতামত কারোরই মনমত হল না । তাছাড়া জার্মানিতে তখন স্বাধীন মত প্রকাশের কোন অধিকার ছিল না । তাঁর ইচ্ছা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি নেবেন । কিন্তু উগ্র স্বাধীন মতামতের জন্য তাঁর আবেদন অগ্রাহ্য হল ।
ইতিমধ্যে বাবা মারা গিয়েছেন । ট্রিয়ারে রয়েছে মা আর প্রিয়তমা জেনি । চাকরির আশা ত্যাগ করে তাদের কাছেই ফিরে চললেন মার্কস । অবশেষে দীর্ঘ প্রেমের পরিণতি ঘটল । মার্কস আর জেনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন । জেনি ছিলেন ধনী পরিবারের অসাধারণ সুন্দরী তরুণী, তবু মার্কসের মত এক দরিদ্র যুবককে বিবাহ করেছিলেন । পরিণামে পেয়েছিলেন চরম দারিদ্র্য আর দুঃখ, স্থায়ী ঘর বাঁধতে পারেন নি তাঁরা । যাযাবরের মত এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে, তবুও জেনি ছিলেন প্রকৃত জীবনসঙ্গিনী । আমৃত্যু স্বামীর সব দুঃখ যন্ত্রণাকে ভাগ করে নিয়েছিলেন ।
বিয়ের পর ফিরে এলেন বলে । এই সময় হেগল ছিলেন জার্মানির শ্রেষ্ঠ দার্শনিক । তাঁর দার্শনিক মতবাদ, চিন্তা যুবসমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল । মার্কসও হেগলের দার্শনিক চিন্তার দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাছাড়া সেই সময় জার্মানির যুবসমাজ যে গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন দেখছিল, মার্কস তা সর্বান্তকরণে সমর্থন করতেন ।
বনে এসে কয়েকজন তরুণ যুবকের সাথে পরিচয় হল । তারা সকলেই ছিল হেগেলের মতবাদে বিশ্বাসী । এদের সাথেই তিনি স্থানীয় বৈপ্লবিক কাজকর্মে যুক্ত হয়ে পড়লেন । নিজের ব্যক্তিত্ব, প্রখর বাস্তব জ্ঞান, অসাধারণ প্রতিভায় স্থানীয় র‌্যাডিকাল মনোভাবপন্ন যুবকদের নেতা হিসাবে নির্বাচিত হলেন । সেই সময়ে তাঁর সম্বন্ধে একটি চিঠিতে ঐতিহাসিক মোসেস তাঁর এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছেন, “কার্ল মার্কসের সাথে পরিচয় হলে তুমি মুগ্ধ হবে, এ যুগের শুধু শ্রেষ্ঠ নন, সম্ভবত একমাত্র প্রকৃত দার্শনিক । মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই প্রগাঢ় প্রজ্ঞার সাথে মিশেছে তীক্ষ্ন পরিহাস বোধ । যদি রুশো, ভলতেয়ার, হাইনে, হেগলকে একত্রিত কর তবে একটি মাত্র নামই পেতে পার, ডক্টর কার্ল মার্কস ।
মার্কস অনুভব করলেন তাঁদের চিন্তাভাবনা, মতামত প্রকাশ করবার জন্য একটি পত্রিকার প্রয়োজন । সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হল রেনিস গেজেট । মার্কস হলেন তার সম্পাদক । তৎকালীন শ্রমিকদের দুরবস্থা সম্বন্ধে সকলকে সচেতন করবার জন্য তিনি এই পত্রিকায় একের পর এক প্রবন্ধ লিখতে আরম্ভ করলেন।
কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হতেই সরকারি কর্মচারীরা সচেতন হয়ে উঠল, এত স্পষ্টতই বিদ্রোহের ইঙ্গিত । সরকারি আদেশবলে নিষিদ্ধ করা হল রেনিস না প্রাশিয়ান সরকার । যে মানুষটির কলমে এমন অগ্নিঝরা লেখা বার হয়, সে আবার নতুন কি বিপদ সৃষ্টি করবে কে জানে । তাই মার্কসকেও দেশ থেকে নির্বাসিত করা হল ।
মাত্র কয়েক মাসের সাংবাদিকতার জীবনে মার্কস এক নতুন রীতির প্রবর্তন করলেন; চিরাচরিত নরম সুর নয়, প্রাণহীন নীরস রচনা নয়, বলিষ্ঠ দৃপ্ত নির্ভীক সত্যকে অসংকোচে প্রকাশ করেছেন । ভাষায় নিয়ে এসেছেন যুক্তি, তথ্যের সাথে সাহিত্যের মাধুর্য । সাংবাদিকতার ইতিহাসে এ এক উজ্জ্বল সংযোজন ।
জার্মান ত্যাগ করে মার্কস এলেন ফ্রান্সে । সাথে স্ত্রী জেনি । শুরু হল নির্বাসিত জীবন । এখানকার পরিবেশ অপেক্ষাকৃত স্বাধীন, মুক্ত । পরিচয় হল সমমনোভাবাপন্ন কয়েকজন তরুণের সাথে । এদের মধ্যে ছিলেন প্রাওধন, হেনরিক হাইনে, পিয়েরি লিরক্স ।
তিনি স্থির করলেন একান থেকেই একটি পত্রিকা প্রকাশ করবেন । তাঁর কলম হয়ে উঠেছিল ক্ষুরধার তরবারী । নিজের লেখা প্রকাশ করবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন । প্যারিস থেকে প্রকাশিত হত একটি জার্মান পত্রিকা Vorwart । এত পর পর কয়েকটি জ্বলাময়ী প্রবন্ধ লিখলেন মার্কস । তাঁর ভবিষৎ জীবনের চিন্তাভাবনার প্রথম প্রকাশ ঘটল এখানে । তিনি লিখলেন, “ধর্ম পৃথিবীর মানুষের দুঃখ ভোলাবার জন্য স্বর্গের সুখের প্রতিশ্রুতি দেয় । এ আর কিছুই নয়, আফিমের মত মানুষকে ভুলিয়ে রাখবার একটা কৌশল ।” দার্শনিকদের সম্বন্ধে বললেন, তারা শুধু নানাভাবে জগতের ব্যাখ্যা করা ছাড়া কিছুই করেনি । আমরা শুধু ব্যাখ্যা করতে চাই না চাই জগৎকে পালটাতে ।
কিন্তু মার্কসের চাওয়ার সাথে সমাজের ওপর তলার মানুষদের চাওয়ার বিবাদ শুরু হল । কারণ তারা পৃথিবীর পরিবর্তন চায় না । বর্তমান অবস্থার মধ্যেই যে তাদের সুখ-ভোগ-বিলাস ব্যসন । পরিবর্তনের অর্থই সে সব কিছু থেকে বঞ্চিত হওয়া । তাই অন্য যে বিষয়েই বিবাদ থাক না, নিজেদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সব দেশের অভিজাত ক্ষমতাবান মানুষেরাই এক ।
মার্কসের তীব্র সমালোচনার মুখে বিব্রত প্রাশিয়ান সরকার ফরাসি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করল মার্কসকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবার জন্য । প্রাশিয়ার অনুরোধে সাড়া দিয়ে ফরাসি সরকার মার্কসকে অবিলম্বে দেশ ত্যাগ করবার নির্দেশ দিল ।
ফ্রান্সের পনেরো মাসের অবস্থানকালে পরিচয় হয়েছিল ফ্রেডারিক এঙ্গেলস-এর সাথে । এই পরিচয় মার্কসের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কারণ পরবর্তী জীবনে এঙ্গলস হয়ে উঠেছিলেন তাঁর প্রিয়তম বন্ধু, সহকর্মী সহযোগী । তিনি যে শুধু মার্কসকে রাজনৈতিক কাজে সাহায্য করেছিলেন তাই নয়, দুঃখের দিনে এঙ্গেলস উদার হাতে বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর সাহায্যে ।
এঙ্গেলস ছিলেন মার্কসের চেয়ে দুবছরের ছোট । তাঁর বাবা ছিলেন জার্মানির এক শিল্পীপতি । ছেলেবেলা থেকেই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল প্রগতিশীল । বাবার ব্যবসার কাজে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন, সেই সময় বিখ্যাত চার্টিস্ট আন্দোলনের সাথে পরিচয় হয় । মার্কসের  সাথে প্রথম পরিচয় হয় যখন তিনি রেনিস গেজেট পত্রিকা সম্পাদনা করছিলেন । বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে প্যারিসে দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের পর থেকে ।
মার্কস প্যারিস ত্যাগ করে এলেন ব্রাসেলসে । এর অল্প কিছুদিন পর এঙ্গেলস এসে মিলিত হলেন তাঁর সাথে । এই মিলন এক নতুন যুগের সূচনা করল ।
কয়েক মাস পর মার্কসকে নিয়ে এঙ্গেলস এলেন ইংলন্ডে । এখানে মার্কসের পরিচয় হল জার্মান শ্রমিক সংঘের নেতাদের সাথে, এছাড়াও লন্ডন  ম্যাঞ্চেস্টারের বিভিন্ন শ্রমিক সাথে । এই পরিচয়ের মাধ্যমে এক নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করলেন তিনি । এতদিন শুধুমাত্র যা কিছু অন্যায় ভ্রান্ত বলে মনে করতেন, তার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র লেখনির মাধ্যমে প্রতিবাদ করতেন । সমাজতান্ত্রিক সঙ্ঘগুলির সাথে তাঁর কোন যোগ ছিল না । সর্বদাই একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন । ইংলন্ডের শ্রমিক সংঘ ছিল, তাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করলেন মার্কস । এঙ্গেলস গেলেন প্যারিসে সেখানকার শ্রমিক সংঘগুলিকে সংগঠিত করবার জন্য ।
প্রায় দুবছরের প্রচেষ্টায় তিনি বিভিন্ন শ্রমিক সংঘের সাথে এক যোগসূত্র গড়ে তুলতে সক্ষম হলেন । প্রত্যেকেই একমত হলেন এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী সংঘগুলির একটি সমন্বয়কারী কেন্দ্রীয় কমিটি থাকা দরকার । গড়ে উঠল আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট লীগ । এই লীগের প্রথম অধিবেশন বসল লন্ডনে ১৮৪৭ সালে । যোগ দিলেন বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, লন্ডনের প্রতিনিধিরা । এখানে রচনা করা হল লীগের নিয়ম বিধি । স্থির করা হল ভবিষৎ কর্মসূচি, এখানেই মার্কস ও এঙ্গেলস যৌথভাবে রচিত কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো সাধারণ সভায় পেশ করলেন ।
এই ম্যানিফেস্টো আধুনিক সমাজতন্ত্রবাদের প্রথম ধ্বনি । এতে সমাজতন্ত্রের মূল নীতি বর্ণনা করা হয়েছে । বলা হল তাদের সংগ্রামের কথা, কোন পথে তারা অগ্রসর হবে সেই পথের দিশা । বিপ্লবের আহ্বান ধ্বনিত হয়ে উঠল এই ইশতেহারে । “কমিউনিস্ট বিপ্লবের আতঙ্কে শাসক শ্রেণীর কাঁপুড়, শৃঙ্খল ছাড়া প্রলেতারিয়েতের হারাবার কিছু নেই । জয় করবার জন্যে আছে সারা জগৎ ।”
মার্কস এই ইশতেহারে “সমাজতন্ত্র” কথাটির পরিবর্তে “কমিউনিজম” নামটি ব্যবহার করলেন । কারণ তাঁর পূর্বেকার দার্শনিকরা “সমাজতন্ত্র” কথাটি ব্যবহার করতেন কিন্তু তাঁর মতবাদ প্রাচীন সমাজতান্ত্রিক ধারণা থেকে স্বতন্ত্র ছিল বলে তিনি কমিউনিজম কথাটি ব্যবহার করলেন ।
এই ইশতেহারে মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হল ১৮৪৮ সালে । সমস্ত ইউরোপের বুকে যেন বিপ্লব শুরু হয়ে গেল । এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শাসক শ্রেণীর বুক ।
মার্কস ছিলেন ব্রাসেলসে । বেলজিয়ামের শাসক শ্রেণীর মনে হল তাঁর মত একজন মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার অর্থ অনিবার্যভাবে  নিজের ধ্বংসের পথকে প্রমস্ত করা । হুকুম দেওয়া হল অবিলম্বে বেলজিয়াম ত্যাগ কর । ইতিমধ্যেই ফ্রান্স, জার্মানি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন ।
১৮৪৯ সালে ইংলন্ডে এসে বাসা বাঁধলেন মার্কস, সঙ্গে স্ত্রী জেনী আর তিনটি শিশু সন্তান ।
সেই সময় ইংলন্ড ছিল ইউরোপের সবচেয়ে উদার মনোভাবাপন্ন দেশ । এবং বিভিন্ন দেশের নির্বাসিতদের আশ্রয়স্থল । যখন মার্কস এখানে এসে পৌঁছলেন, তাঁর হাতে একটি কপর্দকও নেই । সর্বহারা মানুষের সপক্ষে লড়াই করতে করতে উনি নিজেই হয়ে গিয়েছিলেন সর্বহারা ।
পাঁচজনের সংসার । আরো একজন জেনির গর্ভে, পৃথিবীতে আসার অপেক্ষায় ।
দু-কামরার একটা ছোট্ট বাড়ি । পরের দিন খাওয়া জুটবে কি জুটবে  না কেউই জানে না । জামা-কাপড় জুতোর অবস্থা এমন বাইরে যাওয়াই দুস্কর । বহুদিন গিয়েছে শুধুমাত্র একটি জামার অভাবে ঘরের বাইরে যেতে পারেননি মার্কস । অভুক্ত শিশুরা বসে আছে শূন্য হাঁড়ির সামনে । দোকানী ধারে কোন মাল দেয়নি ।
এমন ভয়ঙ্কর দারিদ্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও নিজের কর্তব্য দায়িত্ব থেকে মুহূর্তের জন্যও তিনি বিচলিত হননি । একটি মাত্র পরিবার তো নয়, তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছে পৃথিবীর কোটি কোটি পরিবার । তাদের শিশুদের মুখেও যে এক ফোঁটা অন্ন নেই ।
তবুও মাঝে মাঝে নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না । পথে বেরিয়ে পড়েন । আনমনা উদাসীর মত লন্ডনের পথে পথে ঘুরে বেড়ান । লোকেরা অবাক চোখে দেখে মানুষটিকে । মাথায় ঘন কাল চুল, সারা মুখে দাড়ি, প্রশস্ত কপাল, পরনের কোট জীর্ণ, অর্ধেক বোতাম ছিড়ে গিয়েছে । তাঁর হাঁটার, ভঙ্গিাটা বড় অদ্ভুত কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে তাঁর দুই চোখে ফুটে উঠেছে এক আশ্চর্য প্রত্যয় আর বিশ্বাস । তাঁর কন্ঠস্বর মিষ্ট নয় কিন্তু যখন কিছু বলেন, শ্রোতারা মুগ্ধ বিস্ময়ে তাঁর প্রতিটি কথা অনুভব করে । সেই মুহূর্তে তিনি নম্র বিনয়ী শান্ত ।
কিন্তু যখনই কেউ তাঁর চিন্তার বুকে আঘাত হানে মুহূর্তে তিনি যেন এক অন্য মানুষ, ক্ষুরধার তরবারির মত তাঁর মুখে যুক্তি ঝলসে ওঠে । তখন সামান্যতম করুণা নেই, দয়া নেই, ব্রিটিশ মিউজিয়ামে চলে যান । সমস্ত দিন পড়াশুনা করেন, তখন ভুলে যান সংসারের দারিদ্র্য, সন্তানের অসুখের কথা ।
১৮৫২ সালের ইস্টারের দিন মার্কসের মেয়ে ফ্রানসিসকা মারা গেল । জেনি লিখেছেন “আমাদের ছোট মেয়েটা ব্রঙ্কাইটিসে ভুগছিল, তিন দিন ধরে সে মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছিল, কি ভয়ঙ্কর সে কষ্ট! যখন সব কষ্টের অবসান হল, তার ছোট্ট দেহটাকে পেছনের ঘরে শাস্তেতে শুইয়ে রেখে দিলাম । আমাদের প্রিয় সন্তানের মৃত্যু যখন হল তখন আমাদের ঘর শূন্য । একজন ফরাসি উদ্বাস্তু দয়া করে আমাকে দু পাউন্ড দিলেন, তাই দিয়ে একটা কফিন কিনলাম, তার মধ্যে আমার সোনামানিক নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে । যখন সে পৃথিবীতে এসেছিল তখন তার জন্যে কোন দোলনা দিতে পারিনি । মৃত্যুকালেও তার জন্যে িএকটা শবাধারও দিতে পারিনি ।”
মার্কসের ছটি সন্তানের মধ্যে তিনটি সন্তানই অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিল । কি নির্মম যন্ত্রণাময় জীবন । পৃথিবীর কোন সাহিত্যিক দার্শনিক লেখকের জীবন বোধ হয় এতখানি দুঃখময় হয়নি ।
১৪ মার্চ বেলা পৌনে তিনটেয়  পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক চিন্তা থেকে বিরত হয়েছেন । মাত্র মিনিট দুয়েকের জন্য তাঁকে একা রেখে যাওয়া হয়েছিল । আমরা ফিরে এসে দেখলাম যে তিনি তাঁর আরামকেদারায় শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছেন-কিন্তু ঘুমিয়েছেন চিরকালের জন্য । এই মানুষটির মৃত্যুতে ইউরোপ ও আমেরিকার জঙ্গী প্রলেতারিয়েত এবং ইতিহাস বিজ্ঞান উভয়েরই অপূরণীয় ক্ষতি হল । এই মহান প্রাণের তিরোভাবে যে শূন্যতার সৃষ্টি হল তা অচিরেই অনুভূত হবে । ডারউইন যেমন জৈব প্রকৃতির বিকাশের নিয়ম আবিষ্কার করেছিলেন, তেমনি মার্কস আবিষ্কার করেছেন মানুষের ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম । মতাদর্শের অতি নিচে এতদিন লুকিয়ে রাখা এই সত্য যে, রাজনীতি, বিজ্ঞান, কলা, ধর্ম, ইত্যাদি চর্চা করতে পারার আগে মানুষের প্রথম চাই খাদ্য, পানীয়, আশ্রয়, পরিচ্ছদ । সুতরাং প্রাণ ধারণের আশু বাস্তব উপকরণের উৎপাদন এবং সেই হেতু কোন নির্দিষ্ট জাতির বা নির্দিষ্ট যুগের অর্থনৈতিক বিকাশের মাত্রাই হল সেই ভিত্তি যার ওপর গড়ে ওঠে সংশ্লিষ্টপ জাতিটির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, আইনের ধ্যান-ধারনা, শিল্পকলা এমনকি তাদের ধর্মীয় ভাবধারা পর্যন্ত এবং সেই দিক থেকেই এগুলির ব্যাখ্যা করতে হবে, এতদিন যা করা হয়েছে সেভাবে উল্টো দিক থেকে নয় । কিন্তু শুধু তাই নয় । বর্তমান পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির এবং এই পদ্ধতি যে বুর্জোয়া সমাজ সৃষ্টি করেছে তার গতির বিশেষ নিয়মটিও মার্কস আবিষ্কার করেন । যে সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে এতদিন পর্যন্ত সব বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ ও সমাজতন্ত্রী সমালোচক উভয়েরই অনুসন্ধান অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছিল, তবে উপর সহসা আলোকপাত হল উদ্বৃত্ত মূল্য আবিষ্কারের ফলে ।
তাই তাঁর কালের লোকেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রোশ ও কুৎসার পাত্র হয়েছেন মার্কস । স্বেচ্ছাতন্ত্রী এবং প্রজাতন্ত্রী – দুধরনের সরকারই নিজ নিজ এলাকা থেকে তাঁকে নির্বাসিত করেছে । রক্ষণশীল বা উগ্র গণতান্ত্রিক সব বুর্জোয়ারাই পাল্লা দিয়ে তাঁর দুর্নাম রটনা করেছে, এসব তিনি মাকড়শার ঝুলের মতই ঝেঁটিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন,উপেক্ষা করেছেন এবং যখন একান্ত প্রয়োজনবেশে বাধ্য হয়েছেন, একমাত্র তখনই এর জবাব দিয়েছেন। … আমি সাহস করে বলতে পারি যে মার্কসের বহু বিরোধী থাকতে পারে কিন্তু ব্যক্তিগত শত্রু তাঁর মেলা ভার । যুগে যুগে অক্ষয় হয়ে থাকবে তাঁর নাম, অক্ষয় হয়ে থাকবে তাঁর কাজ ।

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.

[blogger]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget