খেজুরের পরিচিতি
তামার বা খেজুর শব্দটি আল কোরআন ও রাসূলের বাণীতে অনেক বার এসেছে। খেজুর আমাদের সবার অতি পরিচিত একটি ফল। আর খেজুর জনপ্রিয় ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ফল। খেজুরকে সাধারণত বলা হয় রাজকীয় ফল। শুধু এর অতুলনীয় স্বাদ আর গন্ধের জন্য নয় বরং খেঁজুরের খ্যাতি তার অসাধারণ রোগ নিরাময়ের জন্যও। আপনার সারা দিনের ক্লান্তি দুর করতে একটি খেজুর আপনার জন্য যথেষ্ট। সামনে পবিত্র রমজান মাস আর রমজানে খেজুর দিয়ে ইফতার করা, মুমিন মুসলিমদের জন্য আল্লাহর বিশেষ একটা নিয়ামত। সারাদিন রোজা রাখার পর আমরা সাধারণত খেজুর খেয়ে ইফতার শুরু করি। মুমিন-মুসলিমদের জন্য খেজুর খেয়ে ইফতার করা সুন্নত। তাই সাধারণত রমজানে খেজুরের কদর একটু বেশি বেড়ে যায়। খেজুর না থাকলে আমাদের ইফতার যেন পরিপূর্ণতা পায় না।আমরা কম-বেশি সকলেই জানি খেজুর খাওয়া খাছ সুন্নত মুবারক। আর এই সুন্নত মুবারকের মধ্যেই আছে সমস্ত প্রকার ভালাই। আর আমাদের পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মাঝেও খেজুরের অনেক অনেক গুণাবলী ও পুস্তিগুনের কথা বর্ণনা করা আছে। তারপরও বর্তমান সময়ের বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা হাদীছ শরীফ উনাদের আলোকে খেজুর নিয়ে অনেক গবেষণা করে খেজুরের গুনাগুন সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। গবেষণাই তারা বলেছেন, পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ খেজুর অসাধারণ ঔষধিগুনে পরিপূর্ণ একটা ফল। সারা বছর খেজুর খাওয়া আপনার স্বাস্থের পক্ষে খুবই উপযোগী।
খেজুরের পুষ্টিমান:
সাধারণত বলা হয়ে থাকে, বছরে যতগুলো দিন আছে, খেজুরে তার চেয়ে বেশি গুণ আছে। সাধারণত প্রতি ১০০ গ্রাম পরিস্কার ও তাজা খেজুর ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি রয়েছে যা থেকে ২৩০ ক্যালরী শক্তি উৎপাদন করে, ৭৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ২.৫ গ্রাম প্রোটিন এবং ০.৪ গ্রাম ফ্যাট। গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ছাড়াও মেলে অত্যাবশ্যক ভিটামিন উপাদান। এ ছাড়াও মেলে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যামাইনো অ্যাসিড। খেজুরে স্বল্প পরিমাণে পানি থাকে যা কিনা শুকানো অবস্থায় তেমন প্রভাব ফেলে না।সাধারণত পাকা খেজুরে প্রায় ৮০শতাংশ চিনিজাতীয় উপাদান রয়েছে। বাদ-বাকী অংশে খনিজ সমৃদ্ধ বোরন, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়াম ফ্লুরিন, ম্যাগনেসিয়াম, এবং জিঙ্কের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান রয়েছে।সাধারণত কচি খেজুর পাতা সবজি হিসেবে রান্না করে খাওয়া যায়। এছাড়াও, খেজুরের ফুলও খাবার উপযোগী। সনাতনী ধাঁচে স্ত্রী ফুল সাধারণত ৩০০-৪০০ গ্রাম ওজনে বিক্রয় করা হয়। আপনি চাইলে ফুলের কুঁড়ি দিয়ে সালাদ কিংবা শুকনো মাছ বা শুঁটকী দিয়ে চাটনী তৈরী করে রুটির সাহায্যে খেতে পারেন।
খেজুরের উৎপত্তি:
সারা পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে চারশ’ জাতেরও বেশি খেজুর পাওয়া যায়। সাধারণত তুরস্ক, ইরাক এবং উত্তর আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চল মরক্কোয় খেজুরের উপযোগিতা বা উৎপত্তি প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। পবিত্র বাইবেলে খেজুরের কথা পঞ্চাশ বারেরও অধিক জায়গায় উল্লেখ রয়েছে। ইসলামী দেশগুলোতে পবিত্র রমজান মাসে ইফতারীতে খেজুরের আইটেম রাখা অনস্বীকার্য। শুধু তুরস্ক বা ইরাকে নয় মেদজুল এবং দেগলেত নূরজাতীয় খেজুরের চাষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া, অ্যারিজোনা এবং দক্ষিণ ফ্লোরিডায় এখন খেজুরের চাষ করা হয়ে থাকে।হজরত মারইয়াম (আ.) যখন প্রসব-বেদনায় কাতর হয়ে উঠেন, সে সময়ে তিনি খেজুর গাছের নিচে অবস্থান করছিলেন, তখন আল্লাহ তাকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘তুমি এ খেজুর গাছের কাণ্ড তোমার দিকে নাড়া দাও, (দেখবে) তা তোমার ওপর পাকা ও তাজা খেজুর ফেলছে।’ -সূরা মারইয়াম: ২৫
খেজুরের খাদ্য ও পুষ্টি উপকারিতাসমূহ:
খেজুরের উপকারিতায় সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনেক বাণী এসেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যেহ সকালে সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে, সেদিন তাকে কোনো বিষ ও যাদু ক্ষতি করতে পারবে না। আজওয়া খেজুর হলো মদিনার উৎকৃষ্ট মানের খেজুর।’ -সহিহ বোখারি ও মুসলিম। খেজুরের স্বাস্থ্য উপযোগিতা বলে শেষ করা যাবে না। খেজুরের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাকৃতিক আঁশের আধিক্য থাকায় এর উপকারিতা ও গুরুত্ব অনেক। খেজুর তিনটি, পাঁচটি বা সাতটি বেজোড় করে খাওয়ায় শরীরের উপকারিতা সবচেয়ে বেশি। এজন্য হাদিসে বেজোড় সংখ্যার কথা বলা হয়েছে। খেজুরে কী আছে যে, আমরা এতো গুরুত্বের সঙ্গে খেজুর খাই? আসুন চটজলদি জেনে নিই খেজুরের গুনাগুন।১) মস্তিষ্ক সচল রাখেঃ খেজুরের সব থেকে বড় একটা সুবিধা হল খেজুর মস্তিষ্ককে প্রাণবন্ত রাখে। আমাদের ক্লান্ত শরীরে যথেষ্ট পরিমাণ শক্তির যোগান দিতে সক্ষম এই খেজুর।
২) গ্লুকোজের অভাব রোধেঃ সাধারণত রমজান মাসে সারাদিন রোজা রাখার পর পেট খালি থাকে বলে শরীরে গ্লুকোজের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। খেজুর সেটা দ্রুত পূরণ করতে সাহায্য করে।
৩) কোষ্ঠকাঠিন্য রোধেঃ তুলনামূলকভাবে যেসব খেজুর একটু শক্ত সেইসব খেজুরকে পানিতে ভিজিয়ে (সারা রাত) সেই পানি খালি পেটে খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য অনেকাংশে দূর হয়।
৪) গর্ভবতী মায়ের খাবারঃ সাধারণত যেসব মায়েরা গর্ভবতী বা ৭/৮ মাস সময় থেকে গর্ভবতী মায়েদের জন্য খেজুর একটি উৎকৃষ্ট খাদ্য। সাধারণত এই সময়টা গর্ভবতী মায়েদের শরীরে অনেক দুর্বলতা কাজ করে। তখন খেজুর মায়েদের শরীরের এই দুর্বলতা কাটাতে অনেক সাহায্য করে থাকে এবং ডেলিভারীর পর মায়েদের শরীর থেকে অতিরিক্ত রক্তপাত বন্ধ করতে ও খেজুর সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং বাচ্চা প্রসবের পরবর্তী সময়ে শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টির জন্য মায়ের বুকের দুধ বৃদ্ধিতে খেজুর কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
৫) শক্তিদায়ক খাবার: খেজুরে পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালরি থাকে বিধায় যারা একটু দূর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী, সামান্য পরিশ্রমে হয়রান হয়ে যায় তাদের জন্য খেজুর নিয়মিত একটা খাবার বললেই চলে। কেননা খেজুর নিয়মিত খেলে আপনার শরীর ও মন দুটাই ভাল থাকবে।
৬) ক্যান্সার রোধেঃ আমাদের পেটের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে খেজুর। এছাড়াও আমাদের মুখগহ্বরের ক্যান্সার রোধেও এই ফল বেশ কার্যকরী।
৭) হার্টের সমস্যা রোধেঃ বিশেষ করে যাদের হার্টের সমস্যা আছে তাদের জন্য খেজুর খুবই উপকারী। কেননা খেজুর দুর্বল হার্টকে মজবুত করতে সক্ষম। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খেজুর ব্লেন্ড করা জুস খেলে হার্টের সমস্যায় ভুক্তভোগী ব্যক্তি কিছু দিনের মধ্যে ভাল সমাধান পাবেন।
৮) বদহজম রোধেঃ আমাদের মুখের লালাকে ভালোভাবে খাবারের সঙ্গে মিশতে সাহায্য করে খেজুর। ফলে আমাদের বদহজম অনেকাংশে দূর হয়। হৃদরোগ কমাতেও খেজুর বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে।
৯) দুর্বলাত রোধে: আমাদের দেহ ও মনকে সচল ও কার্যক্ষম রাখতে শক্তির প্রয়োজন। এর অভাবে আমাদের দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়,শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং আমাদের মানসিক অবসাদ সৃষ্টি হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে শর্করা জাতীয় খাদ্য শক্তির উৎস হিসেবে বিশেষ কাজ করে।আর এই খেজুর শর্করা জাতীয় খাদ্য হিসেবে খাদ্য শক্তির উল্লেখযোগ্য উৎস হিসেবে কাজ করে।
১০) শরীরের ব্যাধি রোধেঃ খেজুরের মধ্যে থাকা প্রয়োজনীয় পরিমাণে উচ্চমাত্রার শর্করা, ক্যালরি ও ফ্যাট সম্পন্ন খেজুর সাধারণত জ্বর, মূত্রথলির ইনফেকশন, যৌনরোগ, গনোরিয়া, কণ্ঠনালির ব্যথা বা ঠান্ডাজনিত সমস্যা, শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধে বেশ কার্যকরী।
১১) অঙ্গক্ষয় প্রতিরোধেঃ সাধারণত যারা নেশাগ্রস্ত তাদের অঙ্গক্ষয় প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে খেজুর। আপনার স্বাস্থ্য ভালো করতে চাইলে বাড়িতে তৈরী ঘিয়ে ভাজা খেজুর ভাতের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন। এতে করে আপনার মুখের রুচি দিগুণ বৃদ্ধি পাবে। খাবারের প্রতি আগ্রহ বাড়াবে।
১২) প্রয়োজনীয় উপাদানঃ খেজুরের মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণে তেল, ক্যালসিয়াম, সালফার, আইরন, পটাসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ, কপার এবং ম্যাগনেসিয়াম বিদ্যমান যা সুস্বাস্থের জন্য অতি দরকারি।
১৩) হৃদপিণ্ড সুস্থ রাখতেঃ আমাদের সুস্থ হৃদপিন্ডে দেহযন্ত্রে স্বাচ্ছন্দ এবং সতেজ বিধান করে এমন শক্তিদায়ক বা বলবর্ধক ঔষধ হিসেবে খেজুরের জুড়ি নেই বললেই চলে।
খেজুরের ঔষধি গুনাবলী:
১) বর্শ্য (রিকেট) রোগে: মেদোবহ স্রোতের ক্ষয় হতে থাকলেই সাধারণত এই রোগ দেখা দেয়। বিভিন্ন বয়সে এই রোগের নামকরণ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। সাধারণত শিশুদের এই রোগ হলে রিকেট বলা হয় নবপ্রসূতির হলে বলে শুকনো সুতিকা। ৮-১০ বছরের ছেলে-মেয়েরা আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে আপনি একটা কাজ করতে পারেন ১৫-২০ গ্রাম খেজুর নিযে ৩ কাপ পানিতে সিদ্ধ করে দেড় কাপ পরিমাণ নামিয়ে ১৪-১৫ দিন খাওয়ালে রিকেট রোগ অনেকাংশে ভাল হয়ে যাবে।২) রক্তপিত্তে: সাধারণত এ অবস্থায় মাঝে মাঝে গালা দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়ে একবার রক্ত দেখা দিলে আবার ৩-৪ মাস দেখা যায় না। আবার একটা সময় গলা সুড়সুড় করে সাসির সাথে একটু একটু রক্ত দেখা দেয়। এক্ষেত্রে খেজুরের ঔষধি গুনাবলীর ব্যবহার মতে ১৫-২০ গ্রাম পিন্ড খেজুর ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রেখে ২-৩ ঘন্টা পরে চটকে ছেঁকে যে রসালো পানি পাওয়া যাবে তা খাওয়াতে হবে। এতে বেশ উপকার পাওয়া যাবে।
৩) শুক্রবাহ স্রোত ক্ষয়ে: সাধারণত যাদের রৌদ্র একেবারে সহ্য হয় না এবং স্ত্রী সহবাসে দুর্বলতা আছে এবং সেই সাথে কোষ্ঠকাঠিন্যও আছে তারা যদি নিয়মিত ১৫-২০ গ্রাম খেজুর আধা লিটার পানি এবং ১০০ মিলিঃ লিটার দুধ মিশিয়ে এক সাথে ভাল করে সিদ্ধ করে এক কাপ আন্দাজে নামিয়ে ওই রসালো পানি পান করলে উপকার পাওয়া যাবে।
৪) খুসখুসে কাশি: সাধারণত যাদের খুসখুসে কাসি হয় তারা যদি এটাকে উপেক্ষা করে বা গুরুত্ব সহকারে না দেখে; তবে তা থেকে বড় ধরনের কাশের রোগ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে আপনি একটা কাজ করতে পারেন ২০-২৫ গ্রাম পিন্ড খেজুর, ২ কাপ গরম পানিতে সাড়া রাত ভিজিয়ে রাখুন। সকালে ঘুম থেকে উঠে ওই খেজুর চেটকিযে রসালো সরবতের মতো করে খেতে হবে। এই ভাবে আপনাকে অন্ততঃ ১৫ দিন খেলে খুসখুসে কাশিতে আরাম হবে।
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.