অবাক দৃশ্য আর অভিজ্ঞতার ছোঁয়াই "কাশ্মীর".! (Kashmir-India)

মেঘেদের সরিয়ে রাজহাঁসের মতো ভেসে ভেসে এগিয়ে চলেছিল আমাদের প্লেন। ভিতরে চুপ করে ভাবছিলাম, এই অস্থির সময়ে ভূস্বর্গে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? এমন সময়ে সামনের আসন থেকে বিস্মিত চিৎকার। সকলের দেখাদেখি জানালা দিয়ে তাকালাম। এ কী, নীচে তো দাবানল লেগেছে! বিমান সেই উপত্যকা ঘেঁষেই শ্রীনগর বিমানবন্দরে নামল। ভুল ভাঙল আমারও। সবুজ পাইনবনের ধার ঘেঁষে চিনার গাছের সারি। তারই টকটকে লাল পাতায় রঙের আগুন জ্বলছে!
সেই মুগ্ধতা বইতে বইতে শ্রীনগরের বিমানবন্দর ছেড়ে শহরের রাস্তায় এলাম। কিন্তু কোথায় বারুদের গন্ধ? এ তো গোলাপের গন্ধভরা হিমেল বাতাস। বুক ভরে সেই ঘ্রাণ নিচ্ছি, মাথার উপর দিয়ে চলে গেল সেনাবাহিনীর কপ্টার। আমাদের বুকের ভিতরে আবার দপ করে উঠল ভয়। মনে ভিড় করল রক্তাক্ত কোলাজ। সেনার কঠিন চোয়াল, জানালা থেকে তাক করা জঙ্গির রাইফেল, আন্তর্জাতিক টানাপড়েনে যন্ত্রণাবিদ্ধ কাশ্মীরের মুখ। সেই সব চিন্তা মিষ্টি হাসিতে মুছে দিলেন গাড়ির চালক আমির ভাইজান। বললেন, ‘‘কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে আর্মি। সে ব্যাপারে গাইড করে দেব। তবে সে সব জায়গা ছাড়াও এই ভ্যালি বেহদ খুবসুরত।’’

ভূস্বর্গ কাশ্মীরের অপরূপ সৌন্দর্য।

প্রমাণ পেলাম পরের দিনই। শ্রীনগরের চম্পা-চামেলি-গোলাপের বাগিচায় হৃদয় ভরিয়ে, শিকারার বাহারি বাজারে ব্যাগ উপচিয়ে ফের সওয়ার হলাম আমির ভাইয়ের বাদামরঙা গাড়িতে। পাহাড় চিরে সেই বাহন ছুটল পহলগামের দিকে। আশপাশে ঠিক গ্রিমভাইদের রূপকথার বইয়ের মতো দেখতে বাড়িঘর। তাদের তেকোনা চালা, লম্বাটে চিমনি। বরফ পড়েই যাতে চট করে ঝরে যায়, তাই এমন বিলিতি গড়ন। ভিতরের বন্দোবস্ত নাকি প্রাসাদকে লজ্জা দেবে। ‘‘আহা, একটু যদি থাকতে পেতাম!’’ শুনতে পেয়েই চালক বললেন, ‘‘বেশক জনাব। সবই হোম স্টে। আপনাদের পথ চেয়েই তো বাঁচে মানুষগুলো।’’
পহলগাম পৌঁছতেই সাইট সিয়িংয়ের জন্য ছেঁকে ধরল টাট্টুঘোড়ার মালিকরা। এখান থেকে আর গাড়ির রাস্তা নেই। ছটফটে ঘোড়ারা আমাদের খুটখুট করে নিয়ে গেল ভিউ পয়েন্টগুলোয়। দেখাল দারুণ শক্তিমান গুজ্জরদের গ্রাম, রাজা জয় সিংহের মন্দির, পাহাড়ের খাঁজের তুলিয়ান আর বৈশরণ লেক। টলটলে শেষনাগ হ্রদ। সেখানেই আঁধার হল। আমরাও ঝিলমিলে ঝিলমের পাড় ধরে এঁকেবেঁকে শ্রীনগরে ফিরলাম। পথে দেখলাম, দূর পাহাড়ের গায়ে চিকচিকে বিন্দু। শুনলাম, ওগুলো গ্রামের আলো।
পর্বতের ভিতর দিয়েই আরু স্যাংচুয়ারি যাওয়া যায়। তাই চিতাবাঘ তাড়াতে সারা রাত মশাল জ্বালে ওরা। আরও বেশি অ্যাডভেঞ্চারের লোভে পরদিন রওনা দিলাম গুলমার্গে। সেখানে বারো মাস বরফ। তার মধ্য দিয়ে আকাশদোলা গন্ডোলা চলেছে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের স্নো স্টেশনে। সেখানে সাহসীরা মাউন্টেন-গ্লাস পরে স্কি করছে। একটু নীচে শান্তশিষ্ট গলফ কোর্স। পাশেই বরফের রেণু মাখা টিউলিপ বাগান। চার ধারে কত ক্রিসমাস ট্রি! কে বলে কাশ্মীর মানেই হানাহানির ভয়ে সুনসান তল্লাট? এ তো জুলাইতেই বড়দিনের মেলা বসেছে জমজমাট। ফুর্তিবাজরা শিস দিতে দিতে চলেছে ট্রেকে। অনন্তনাগের হিমকুণ্ডে ক্লান্তি ধুয়ে নেবে। অবন্তীপুরে গিয়ে পাণ্ডবদের মহল খুঁজবে। আমি ওদের জিজ্ঞেস করি, ‘‘সে তো পুলওয়ামার পাশে। যেতে দেয়?’’ তা শুনে গোটা দল হেসে লুটোপুটি। ‘‘পাহারা দিচ্ছেন স্বয়ং হিমালয়। বিপদ কীসের?’’ বলেই তারা শশব্যস্তে হাঁটা লাগাল ফিরোজপুরি ক্যানালের দিকে। সেখানে আজ ট্রাউট মাছ ধরার উৎসব আছে।
উপত্যকার অন্য ধার দিয়ে সোনমার্গের গিরিপথে যাওয়া যায়। সেই পাকদণ্ডীতে অনেক সুড়ঙ্গ। পাহাড় ফুঁড়ে কেবলই বেরোচ্ছে ঝরনা। তার পাশে তাঁবু খাটিয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন অভিযাত্রীরা। আর একটু দূর যেতেই হুড়মুড়িয়ে নামতে থাকি উতরাই পথে। তখনই হুঙ্কার দিতে দিতে সামনে এসে দাঁড়াল পান্না রঙের বিশালদেহী এক নদীপুরুষ।
সেই হল সিন্ধু নদ। তার উদ্দাম জলরাশি পাহাড় চুরমার করে দিচ্ছে। গুমগুম শব্দ উঠছে চরাচর জুড়ে। যেন নদীর রাজা বজ্রনির্ঘোষে হুকুম দিচ্ছে, ‘‘আমার এই পাড় ধরে লাদাখ চলো। সে দিকেই আমার ঘর। তিব্বত। মানসরোবর।’’ সম্মোহিত আমি এগিয়ে যাই। গাইড বলেন, ‘‘ও দিকে অমরনাথ। যেতে গেলে শ্রীনগর ফিরে পারমিট করাতে হবে।’’ সময়-প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি বলে সিন্ধু নদের সে কী অভিমান! পাথরে ঘা দিতে দিতে ফুঁসতে ফুঁসতে ছুটোছুটি করে। তখনই উচ্চশৃঙ্গ গিরিরাজকে সাক্ষী মেনে কবুল করি, ফিরব... ফিরব... ফিরব...। শুধুমাত্র মুশকিল হয়ে গেল একটাই-আমি যে, উপত্যকাকে আপনাদের হয়েও কথা দিয়ে এসেছি!

জম্মুর জলে ও স্থলে


"কাশ্মীর" থেকে জম্মুকে আলাদা করেছে পীরপঞ্জাল পর্বতশ্রেণি। পঞ্জাবঘেঁষা এই শহরটি ভারতের উত্তরতম রাজ্যের শীতের রাজধানী। দুর্গ-মন্দিরে সাজানো জম্মু দেখতে অন্তত দিন তিনেক সময় লাগে। জম্মু বাসস্ট্যান্ড থেকে মাত্র দু’কিলোমিটারেই বিশাল প্রমোদ-উদ্যান চৌগান। শহর থেকে মাত্র
৬৪ কিলোমিটার দূরে রিয়াসি-তে বুনো ঝোপঝাড়ের মধ্যে চারশো বছর ধরে জেগে আছে জারোয়ার সিংহের ভীমগড় ফোর্ট। রাজপুত স্থাপত্য ও মুঘল শৈলীর অনবদ্য মিশেল। অন্দরে ভীমার্জুনের মন্দির, ঘাটকাটা পুকুর, ছোট-বড় ঘর, অস্ত্রশাল। এই দুর্গের দেওয়ালে কান ঠেকালে চন্দ্রভাগার কুলকুল ধ্বনি স্পষ্ট শোনা যায়।
জম্মু থেকে মাত্র ২৮ কিলোমিটার দূরে চেনাবের তীরে আখনুর দুর্গ। এখানেই গুলাব সিংহকে রাজমুকুট পরিয়ে দেন রঞ্জিৎ সিংহ। আর রঙে-রূপে ‘ছোটা কাশ্মীর’ বলে পরিচিত হল ভাদরওয়া ভ্যালি। সেখানে তিরতির করে বয়ে চলে নীরু নদী। হিমাচল সীমান্তে রয়েছে সিন্ধু সভ্যতার যুগের জনপদ বিশ্বস্থলী, আজকের বাসোলি। হরপ্পা-মহেঞ্জোদড়োর ঢঙের আশ্চর্য নগর-পরিকল্পনা তার, তেমনই কেতার ভূগর্ভস্থ নালা-প্রণালী। আর আছে পাথরকাটা সায়র, পুরোহিতের আবাস, বৈদ্যের বাড়ি, রাজার সাতমহলা। সেখানে অন্তত কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস বসত করে। নিসর্গের স্বাদ চাইলে শৈলশহর পানিটপ-কে টপকে সনাসারে যেতে হবে। পেয়ালা আকৃতির এই ঘাসভূমে বিরাট বিরাট ফার গাছ, মধ্যিখানে পশু চরে বেড়ায়। আর মানুষ আসে নয়নাভিরাম রিসর্টে আরাম খুঁজতে।
জম্মু রেলস্টেশন থেকে জাতীয় সড়ক ধরে ৪৮ কিলোমিটার উজিয়ে গিয়ে ২৮০০ ফুট উঁচুতে কাটরা শহর। সেখান থেকে ঘোড়ার পিঠে বা ডুলি চড়ে চড়াই-উতরাই পথে চলে আসুন দরবারে। এখানেই দর্শন দেবেন মা বৈষ্ণোদেবী।

যাত্রাপথ

প্রত্যেক দিন দিল্লি থেকে জম্মু হয়ে শ্রীনগরে বিমান উড়ছে। কলকাতা থেকে রয়েছে জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেস। জম্মু পৌঁছবে পরের দিন। পুজোর ছুটিতে বিশেষ ট্রেনও রয়েছে।

খাবারে কাশ্মীরি জোশ

কাশ্মীরের রুচিসম্পূর্ণ খাবার

ঠান্ডার দেশ। তাই শরীর গরম রাখতে মাছ-মাংসের এলাহি আয়োজন। তবে রসুনগন্ধি মটন রোগন জোশ, স্বাদু পালক চিকেনের পাশাপাশি টক-মিষ্টি  দম-আলু খেতে ভুলবেন না। ওয়াজ়ওয়ান এ রাজ্যের বিখ্যাত থালি। তাতে সাজানো মেথি আর তবক মাজ়, কয়লায় সেঁকা ভেড়ার কাবাব, ধনিয়ালি কোর্মা, মাংসের কোফতা রিশতা, মশলাদার দইয়ে মজানো মাংসের বড়া গুস্তাবা আর অজস্র সুখাদ্য। সঙ্গে চটকদার আচার। শেষ পাতে আখরোটের চাটনি, ঠান্ডা দই ঘুঁটে তৈরি ঘন লস্যি। সুজি, ঘি, ড্রাই ফ্রুটের হালুয়া মেলে রাস্তার ধারে। তার সঙ্গে চুমুক দিন নোনতা চায়ে। জ়াফরান ফোটানো ‘কেহওয়া’ খেলে সঙ্গে নিন সাংগ্রাম। তার পরত ভাঙলে মিষ্টি পুর মাখনের মতো গলবে।

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.

[blogger]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget