বৈচিত্রের অবাক শহর “সাউন্ড অব মিউজিক” (Salzburg City in Austria)



সামনে একদম সোজা খাড়াই একটা রাস্তা। মাথা তুলে তাকালে ও পারে কিছু ঠাহর হয় না। দুরুদুরু বুকে বরের দিকে তাকালাম। তার অবস্থাও তথৈবচ! উপরন্তু গলায় ভারী ক্যামেরা। সাহায্যের ভাবনা ভুলে পা বাড়ালাম... দুর্গের প্রবেশপথে পৌঁছে এভারেস্ট জয়ের চেয়ে কম আনন্দ পাইনি, এটুকু বলতে পারি।
সালজ়বার্গের সবচেয়ে উঁচুতে এই হোয়েন সাল‌জবার্গ ফোর্ট্রেস। ইউরোপের অন্যতম বড় ক্যাসলগুলির মধ্যে একটি। এখান থেকে আল্পসের চুড়োও নাগালে মনে হয়। গোটা শহর দেখা যায়। শহরের আধুনিক আর প্রাচীন দুই মেজাজের মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়েছে সালজ নদী। দুর্গের দুর্গমতা উপভোগ করে নীচে নামার সময়ে দেখা গেল, লিফটে করে সটান উপরে চলে আসার আলাদা রাস্তা রয়েছে। প্রচণ্ড আফসোস হতে হতেও মনে হল, যে পথটা পেরিয়ে দুর্গদ্বারে পৌঁছেছি, সেটাও তো কম উপভোগ্য নয়।
অস্ট্রিয়া এমনিতেই রূপসী। তার মধ্যে সালজবার্গ সেরা। আল্পসের উত্তরের সীমানা ঘেঁষা এই শহর বাঙালির কাছে ‘সাউন্ড অব মিউজিক’-এর নস্ট্যালজিয়া বয়ে আনে। এখানে এলে বোঝা যাবে রবার্ট ওয়াইজ কেন তাঁর মিউজিক্যাল এখানে শুট করেছিলেন। ‘সাউন্ড অব মিউজিক’ টুরও আছে। যে সব জায়গায় শুটিং হয়েছিল, সেই লোকেশন আর প্রপস দেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে।
সালজবার্গের অন্যতম আকর্ষণ মোৎজার্ট। এখানেই শিল্পীর জন্ম-কর্ম। ওল্ড টাউন সেন্টারে মোৎজার্টের বাড়ি-মিউজিয়াম অবশ্য দ্রষ্টব্য। তবে শিল্পী শুধু স্ট্যাচু আর মিউজিয়ামেই আটকে নেই। বিপণন কোন জায়গায় যেতে পারে তা মোৎজার্টের নামের বিভিন্ন মার্চেন্ডাইজ বিক্রির হিড়িক দেখলে বোঝা যাবে। মৃত্যুর তিনশো বছর পরেও তিনি প্রাসঙ্গিক এবং জীবন্ত।

 ওল্ড টাউনের আকর্ষণ মোৎজার্ট


বেড়াতে গিয়ে যদি আলসেমি করতে ইচ্ছে করে, তা হলে সালজবার্গ তার আদর্শ জায়গা। ওল্ড টাউনে থাকলে তো হয়েই গেল। বারান্দায় বসেই নিসর্গ উপভোগ করা যাবে। আমরা ছিলাম নিউ টাউনে। ছোট শহর যেহেতু, তাই ট্রান্সপোর্টের প্রয়োজন আমাদের পড়েনি। চাইলে আপনি সাইকেল ভাড়া করে নিতে পারেন। নিউ টাউন থেকে বেরিয়ে নদীর ধার ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজ পেরিয়ে দিব্যি রোমানিয়ান-গথিক আর্কিটেকচারের রাজ্যে ঢুকে পড়া যায়।
কয়েক পা হাঁটলে সিটি স্কোয়্যার। চার ধারে অসাধারণ স্থাপত্য নির্মাণ। তার মাঝখান দিয়ে সরু সরু রাস্তা। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অজস্র দোকানপাট, রেস্তরাঁ, কাফে। একটা জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়লেই হল। দূরে আল্পসের ঝলক, পাহাড়ের ধাপে সালজ দুর্গ, স্কোয়্যারের মাঝে বা গলির মুখে কোনও মিউজিশিয়ান নিজ সৃষ্টিতে মগ্ন... নিসর্গ, সঙ্গীত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে।
আমরা গিয়েছিলাম ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। তখন শহর তৈরি হচ্ছে ক্রিসমাসের জন্য। কপালজোরে চোখের সামনে ক্রিসমাস ট্রি লাগাতে দেখার অভিজ্ঞতাও হয়ে গেল। ষাট-সত্তর ফুট উঁচু স্প্রুস গাছ নিয়ে এসে চত্বরের মাঝ বরাবর রাখা হচ্ছিল। এত বিশাল একটা গাছ এ ভাবে তুলে এনে আবার পুঁতে দেওয়ার দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস হত না!
দোকানপাট দেখে মনে হচ্ছিল, ক্রিসমাসের আগে সুন্দরী তার মেকআপ শুরু করেছে। এমনিতে গেটরাইডগ্যাস শপিংয়ের স্বর্গ। দোকানগুলির বৈশিষ্ট্য তার আয়রনের তৈরি সাইনবোর্ডে। সন্ধে হতেই জায়গা এত জমজমাট হয়ে যায় যেন মনে হবে, এখনই কার্নিভ্যাল শুরু হবে।

 সালজবার্গের সুন্দর মহল

যেহেতু টুরিস্ট প্রধান জায়গা এবং অস্ট্রিয়ায় ইউরোর মাধ্যমেই কেনাবেচা হয়, সুতরাং জিনিসপত্র একটু দামি ঠেকতে পারে। শপিং মলও আছে। কিন্তু গেটরাইডগ্যাসের পাথুরে রাস্তায় হাঁটলে ইতিহাসের যে গন্ধ পাওয়া যায়, তার আকর্ষণ ছাড়া মুশকিল। হাল ফ্যাশনের পোশাক তো পাবেনই। চাইলে জুলি অ্যান্ড্রুজের মতো এ দেশের ট্র্যাডিশনাল পোশাকও পরতে পারেন। এখান থেকে উলের টুপি, মাফলার কিনতে পারেন। আপনার বন্ধুরা ঈর্ষা করবেনই।
সুভেনিরের জন্য টি-শার্ট, কফি মাগ, বাড়ি সাজানোর টুকিটাকি, বেল কিনতে পারেন। আর আছে মোৎজার্টের নামাঙ্কিত অজস্র সুভেনির। এখানকার স্টোনের গয়না যেমন ক্লাসি, তেমনই স্টাইলিশ।
শপিং মলগুলো প্রধানত শহরের আধুনিক অংশে। কিন্তু ওল্ড টাউন চত্বরে থাকলে ওই দিকে আর যেতে ইচ্ছে করবে না। এই এলাকাতেই সালজবার্গ ক্যাথিড্রাল, হোলি ট্রিনিটি চার্চ, সেন্ট পিটার্স অ্যাবে, মোৎজ়ার্টের বাড়ি। ঘুরতে ঘুরতে সময়ের ঠিক থাকে না।

ডিসেম্বরের ঠান্ডায় আর কিছু না হোক জবরদস্ত খিদে পায়। এখানের সসেজ, হ্যাম না চাখলে পস্তাতে হবে। সব দোকানের বাইরে মেনু লেখা। অনেক জায়গায় লেখা ‘কেবাপ’। খোঁজ নিয়ে জানলাম আমাদের কাবাবের অস্ট্রীয় ভার্সান কেবাপ। স্বাদ মোটামুটি একই। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যুর আসল মর্মার্থ এখানে এসেই বুঝেছি। ইউরোপে এসে সসেজ না খাওয়া অপরাধ। তাই একটা প্ল্যাটার অর্ডার করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত টেবিলে যে পদটা এসে পৌঁছল সেটা আমার গোটা দিনের খাবার! আকারে প্রকারে সসেজগুলো বৃহৎ বললে কম বলা হয়।
সালজ়বার্গের ডেজ়ার্ট মিস করবেন না। এখানকার চকলেট, পেস্ট্রির স্বাদ অপূর্ব। চাইলে প্রিয়জনের জন্য হ্যান্ডমেড চকলেট কিনে নিয়ে যেতে পারেন। বেশ মজাদার একটি জিনিস খেয়েছিলাম, গ্লু ওয়াইন। গরম ওয়াইন। ধোঁয়া ওঠা ওয়াইন খাওয়ার অভিজ্ঞতা সেই প্রথম।

আর একটি অভিজ্ঞতাও ভোলার নয়। হোয়েনসাল‌জ়বার্গ ফোর্ট্রেস যাওয়ার রাস্তায় একটি রেস্তরাঁ পড়ে। খাড়াই রাস্তা চড়তে চড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়লে দু’দণ্ড জিরিয়ে নেওয়া যায়। পাহাড়ের খাঁজে অদ্ভুত ভাবে তৈরি এই রেস্তরাঁ। ভিতরের স্থাপত্যও নজর টানে। তবে রেলিংয়ের ধারে বসে চোখ মেললে শহরের সীমানা ছাড়িয়ে সবুজ প্রান্তর, সেই প্রান্তর ছাড়িয়ে আবছায়া আল্পস। মুহূর্ত ওখানেই থমকে যায়!

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.

[blogger]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget