হাতে যদি থাকে একটা দিন, আর থাকে ইতিহাসের প্রতি টান, তা হলে আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়ুন মোগলমারি আর কুরুম্বীরা ফোর্ট দেখতে।
হাওড়া থেকে প্রথমে লোকাল কিংবা এক্সপ্রেস ধরে খড়্গপুর।খড়্গপুর স্টেশন থেকে বের হলেই বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে দাঁতনের বাসে চেপে মোগলমারি। খড়্গপুর থেকে মোগলমারি ঘণ্টা দেড়েকের পথ।সরাসরি দাঁতনের বাস না মিললে একটা ব্রেক জার্নি বেলদা অবধি। বেলদা থেকে মোগলমারি।
***মোগলমারি
হাইওয়েতে বাসস্টপের নাম মোগলমারি।একটু পথ হাঁটতেই চোখে পড়ল মোগলমারির দিক নির্দেশ করে হাইওয়েতে একটি বোর্ড দেওয়া রয়েছে।একটি বোর্ড ভেঙে পড়েছে অবশ্য, তাতে কুছ পরোয়া নেই।হাইওয়ে থেকে ডানদিকের সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তা।মিনিট দুইয়ের হাঁটা পথ।যেতে যেতে বাঁদিকে চোখে পড়ল বড় হরফে লেখা রয়েছে ‘মোগলমারি বৌদ্ধবিহার’।গেট খুলে প্রবেশ করলাম। অপেক্ষা করছিল ষষ্ঠ শতকের একাধিক বিস্ময়।কয়েকটা সিঁড়ি উঠতে হল। দু’পাশ পাতাবাহারের কেয়ারি করা।উঠতেই ডানদিকে বোর্ড, ‘মোগলমারি এক্সক্যাভেশন সাইট’। বোর্ডের ঠিক পিছনে খড়ের চালা দেওয়া ছোট্ট অফিসঘর।
সিঁড়ির শেষ মাথায় একটা বড় মঞ্চের মতো ঘর, বড় বড় করে লেখা রয়েছে ‘মোগলমারী তরুণ সেবা সংঘ ও পাঠাগার’।শুনেছিলাম এই পাঠাগারের হাতেই এইবৌদ্ধ বিহারের রক্ষণাবেক্ষণের ভার রয়েছে!
সেখানেই গেলাম প্রথমে।বসলাম। আগে ফোনে কথা হয়েছিল মোগলমারির দায়িত্বে থাকা কিউরেটর গৌরগোপাল দে-র সঙ্গে।আলাপ-পরিচয় হল।কিউরেটরের সঙ্গেই শুরু হল ষষ্ঠ শতকের বিশাল বৌদ্ধবিহার পরিক্রমা।
পুরাতাত্ত্বিকদের মতে, মোগলমারি পশ্চিমবঙ্গের সর্ববৃহৎ বৌদ্ধবিহার। নালন্দার সমসাময়িক।হিউ-এন-সাং এসেছিলেন এখানে, তিনি তার ‘সি-ইউ-কি’ভ্রমণ বৃত্তান্তে উল্লেখ করেছেন এই বৌদ্ধবিহারের কথা। ন’দফায় এখানে খননকার্য চালায় পুরাতত্ত্ব বিভাগ।কিউরেটর গৌরবাবু স্থানীয় বাসিন্দা। মাঝবয়সী,বেশ প্রাণবন্ত।প্রথম দফার খননকার্য থেকেই তিনি যুক্ত আছেন পুরাতত্ত্ব বিভাগের সঙ্গে।জানেন অনেক অজানা কথা।শুরু করলেন মোগলমারির অজানা ইতিহাস বলতে।
সালটা ১৯৯৯। প্রাচীন বাংলায় নদী বাণিজ্য সংক্রান্ত পুরাতাত্ত্বিক খোঁজে সুবর্ণরেখার গতিপথ ধরে পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনে আসেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক অশোক দত্ত। তাঁর সঙ্গে ঘটনাসূত্রে আলাপ হয় দাঁতনেরই এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের।তিনিই অশোকবাবুকে এই জায়গার সন্ধান দেন।তখন এই জায়গার নাম ছিল ‘সখিসেনা ঢিবি’।
মোগলমারি বৌদ্ধ বিহার
প্রায় তিনশো বছর আগে এই প্রণয়কথা নিয়ে বর্ধমানের লোককবি ফকিররাম লিখেছিলেন ‘সখিসেনা’বলে একখানি কাব্য।এই সখিসেনাকে নিয়ে সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ এক সময় লিখেছিলেন ‘কিংবদন্তীর দেশে’। অনুমান, অতীতের এই সখিসেনার পাঠশালা আজকের মোগলমারি।যদিও এ বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। মোগলমারির অতীত ইতিহাস অনুসন্ধান করে জানা গেল যে এক সময় মোগলরা এই পথ ‘মাড়িয়ে’যেত।‘মাড়ি’,অর্থাৎ পথ।সে কারণেই নাকি নাম হয় ‘মোগলমারি’।আবার কারও মতে, তুকারুই নামে এক জায়গায় মোগল-পাঠানদের মধ্যেযুদ্ধ হয়েছিল, তাতে মারা গিয়েছিলেন বহু মোগল সৈন্য, তারপর থেকেই নাম হয় ‘মোগলমারি’।
তবে মোগলদের অনেক আগেই যে এখানে সমৃদ্ধ জনপদের অস্তিত্ব ছিল, সে বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই।কারণ, দাঁতনের প্রাচীন নাম দন্তভূক্তি।কেউ কেউ বলেন, এখানে বৌদ্ধ জনপদ ছিল।আর এই মোগলমারি বৌদ্ধবিহারে ছিল বুদ্ধদেবের দাঁত।এখানকার বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বুদ্ধের দাঁতের আরাধনা করতেন।সেই থেকে জায়গার নাম হয় ‘দাঁতন’।তবে বৈষ্ণবরা মনে করেন, চৈতন্যদেবের ফেলে যাওয়া দাঁতন থেকেই জায়গার নাম হয় দাঁতন।
প্রাচীন দণ্ডভুক্তি ছিল এক সময়ে শশাঙ্কের রাজ্য।তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, শশাঙ্ককে যাঁরা ‘বৌদ্ধ বিদ্বেষী রাজা’বলেন তাঁরা এই মোগলমারি বৌদ্ধবিহারের অস্ত্বিত্ব নিয়ে কী বলবেন? গবেষকদের মতে, এই মহাবিহারেও কিন্তু হিন্দু প্রভাব পড়েছিল, যার একাধিক প্রমাণ মিলেছে।
কিউরেটর গৌরবাবুর সঙ্গে মোগলমারি বৌদ্ধবিহার ঘোরা চলছে। চারপাশে অজস্র ঢিবি।খোঁড়া রয়েছে।গাছ-পাতা ও সংরক্ষণের অভাবে বেশ দৈন্যদশা।নামমাত্র বাঁশ দিয়ে ঘেরা।কেউ কেউ তো ষষ্ঠ শতকের ইঁটের টুকরো ‘স্মৃতিচিহ্ন’হিসেবে ঘর অবধি নিয়ে চলে গিয়েছেন নিজের মনে করে! ছাগল নির্বিঘ্নে ঘাস খাচ্ছে বৌদ্ধবিহারের ভেতরে।
কিউরেটরের কাছ থেকে জানা গেল, ২০০৪ সালে প্রথম খোঁড়ার কাজ শুরু হয়।তখন এখান থেকে পাওয়া যায় একখানি সিলমোহর যেখানে লেখা ছিল,‘শ্রীবন্দক মহাবিহার আর্য ভিক্ষু’।পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে ন’দফায় এখানে ব্যাপক ভাবে খননকার্য চলে।ধীরেধীরে মেলে মঠের প্রধান প্রবেশদ্বার,উপাসনা ক্ষেত্র। প্রমাণিত হয় যে, বিহার নয়, এখানে ছিল এক বিরাট মহাবিহার।
দেশবিদেশের বৌদ্ধ ভিক্ষু, লামারা এখানে আসতেন।এই মহাবিহারে থাকতেন একাধিক লামা ও বৌদ্ধভিক্ষু। ছোটছোট কুঠুরিগুলি তার প্রমাণ। যার ওপরের অংশ এবং ভেন্টিলেটর পর্যন্ত খোঁড়ার কাজ হয়েছে।কেবলমাত্র শিক্ষা নয়, এখানে বহু মানুষ আসতেন দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসার জন্যও।কেউ কেউ বহু দূর থেকে আসতেন বুদ্ধের পায়ে অর্ঘ্য নিবেদনের জন্যও। যে অর্ঘ্যের নমুনা রয়েছে মিউজিয়ামে।বিশেষ অনুমতি থাকার কারণে সেই অর্ঘ্য হাতে নিয়ে দেখার সৌভাগ্য হল।
মহাবিহারের একটি অংশে বিশেষভাবে গ্রিন হাউসের মতো ঢাকা দেওয়া রয়েছে দেখলাম।সেখানে একটু নীচে নামতে হল।নেমে শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা।বিহারের নীচের কারুকাজ করা অংশে বিভিন্ন মুদ্রায় পরপর একাধিক বৌদ্ধমূর্তি।অসাধারণ তার নির্মাণ কৌশল।সবই নামমাত্র সংরক্ষিত।কিউরেটরের কথায়, হীন যান ও মহাযান সম্প্রদায়ের প্রভাব পড়েছিল এই বিহারে।মহিলাদেরও প্রবেশ ছিল এই বিহারে যার প্রমাণ হিসেবে দেখতে পাওয়া গেল দেওয়াল গাত্রের কিছু মূর্তি।
ধ্বংসের চিহ্ন দেখেই বোঝা যায়, বারে বারে বহিঃশত্রুর আক্রমণ হয়েছে এই বিহারে। খননের একেবারে প্রথম দিকে তিব্বতের লামারা এসেছিলেন।পরে চিন,নেপাল, জাপান-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এসেছেন এই মোগলমারিতে।একবার বৌদ্ধ ফেস্টিভ্যালও হয়েছে এখানে।
মোগলমারিতে প্রাপ্ত ক্যাটালগের ভিত্তিতে জানা যায় ন’দফা খননে কী কী মিলেছে।বৌদ্ধমূর্তি, স্ট্যাকো মূর্তি, মাটির নকশা করা পাত্রের পাশাপাশি সে সময় ব্যবহৃত এসেন্স বা আতরের বোতলের নল অংশগুলি উদ্ধার হয়েছে।যেগুলি সত্যিই খুব আকর্ষণীয়।
ভারতীয় পুরাতত্ত্বের ইতিহাসে এটি একমাত্র মহাবিহার যেখানে একই দিনে প্রায় ৯৫টি বৌদ্ধমূর্তি উদ্ধারের নজির রয়েছে। প্রায় ৫৪ রকমের নকশা করা ইট মিলেছে মোগলমারিতে। মিউজিয়মে এসবের একাধিক নমুনা দেখতে পাওয়া যায়। তবে অযত্নে রক্ষিত। সিকিউরিটি, সিসিটিভি চোখে পড়েনি!
ইতিপূর্বে ইংরেজ আমলেও নাকি এক বার খনন হয়েছিল।তবে তারা খননে বিশেষ আগ্রহ দেখাননি।ফলে এই ঢিবি চাপাই ছিল।
***কুরুম্বীরা ফোর্ট
কুরুম্বিরা ফোর্ট
মোগলমারি বাসস্টপ হাইওয়ের ধারে। সেখান থেকে বাস ধরে এবার কুকাইয়ের পথে।সরাসরি কুকাইয়ের বাস পাওয়া যায় মোগলমারি থেকে। না হলে বেলদা কিংবা কেশিয়ারির বাস ধরতে হবে।সেখান থেকে কুকাই বা হাজিপুর।মোগলমারি থেকে কুকাই আধঘণ্টার পথ। ভাড়া ১০ টাকা।
কুকাই বাসস্টপেনেমেই বাঁদিকে একটি মোরামের রাস্তা দেখতে পেলাম।স্থানীয়দের কথায়, এই রাস্তা ধরে ২ কিমি গেলেই গগনেশ্বর। সেখানেই কুরুম্বীরা ফোর্ট। কুকাই বাসস্টপ থেকে কুরুম্বীরা ফোর্ট টোটো ভাড়া ১০টাকা।
দুর্গের প্রধান দরজায় টোটো নামিয়ে দিল।দুর্গের প্রধান দরজায় দাঁড়িয়ে আপনি কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যাবেন যে পশ্চিম মেদিনীপুরের কোথাও রয়েছেন। লোকচক্ষুর আড়ালে ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায়। মাকড়া পাথরের দুর্গ, বিরাট অংশ জুড়ে।রাজস্থান, গুজরাত, দিল্লি, হিমাচল, দক্ষিণের বিভিন্ন দুর্গ দেখার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হল, একে দুর্গ বললেও দুর্গ ঠিক নয়।
কারণ পরিখা, ওয়াচ টাওয়ারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনও কিছুই নেই এখানে।চারপাশের আকৃতি দিল্লির দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস-এর মতো। আর একপাশে একটি বিরাট ইমারত। মাথায় তিনটি গম্বুজ। এই দুর্গের কোনও লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়নি। যেটুকু জানা যায় তা লোকবিশ্বাস ও জনশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে।
ওড়িশা গেজেটিয়ার থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চতুর্দশ শতকে ওড়িশার রাজা গজপতি কপিলেন্দ্রদেবের আমলে এই দুর্গ গড়ে ওঠে।পরে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে দুর্গ অভ্যন্তরের জগন্নাথ মন্দির ভেঙে মসজিদ বানানো হয়।বর্তমানে মসজিদের তিনটি গম্বুজ এখনও দেখতে পাওয়া যায়।
স্থানীয়দের কাছ থেকে ইতিহাসের আরও এক ভাষ্য উঠে আসে। রামচন্দ্র নাকি বনবাসের সময় ভাই লক্ষ্মণ ও স্ত্রী সীতার সঙ্গে এখানে আসেন।ঘন জঙ্গল, অতএব, থাকার জন্য বানান দুর্গ।আর একরাতে নাকি এই দুর্গ বানানো হয়েছিল!
মিথ হোক কিংবা ইতিহাস— কুরুম্বীরা ফোর্টের স্থাপত্য কিন্তু নজর কাড়বে আপনার।এর স্তম্ভ এবং ভেতরের কিছু নকশা চোখে পড়ার মতো।ঘুরে দেখতে ঘণ্টাখানেক। অনেক মুহূর্ত ক্যামেরবন্দি করে দিনের শেষে ঘরে ফেরার পালা।
ফিরতি পথে মনে হল, এই দুই জায়গা নিয়ে অসাধারণ পর্যটনকেন্দ্র তৈরি হতে পারে।কারণ, দিঘা এবং ওড়িশা ফেরত পর্যটকেরা হাইওয়ের ধারে মোগলমারি এবং কিছুটা দূরে কুরুম্বীরা ফোর্ট অনায়াসে দেখে নিতে পারেন।শুধু গাড়ি কিংবা বাসের পর্যটকরাই নন, ট্রেনের যাত্রীরাও খড়্গপুরে নেমে এই জায়গাদু’টি দেখে নিতে পারেন।তবে সেক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থার সামান্য উন্নতি ও প্রচার প্রয়োজন।প্রশাসন ও পর্যটন বিভাগেরও বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবা উচিত।যেভাবে নালন্দা কিংবা দক্ষিণের মহাবলীপুরম সেজে উঠেছে, ঠিক সে ভাবে মোগলমারি ও কুরুম্বীরাও সেজে উঠতে পারে।
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.
EmoticonClick to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.