আমি এখনো পর্যন্ত উড়োজাহাজে চড়িনি। আমার জানা নেই, উড়োজাহাজ যখন মেঘের মধ্যে দিয়ে উড়ে চলে তখন যাত্রীদের পাখির মতো উপলদ্ধি হয় কি না। উড়োজাহাজে উঠেতে না পারার আফসোস আছে বটে। আকাশ পথে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা না থাকলেও আমার মনে হয় স্থল পথে, নদী পথে, সমুদ্র পথে ভ্রমণ বেশি উপভ্যেগ্য হয়। তবে উড়োজাহাজে আরাম বেশি এবং সময় ও বাঁচে।
স্বর্গে অনেক আরামে থাকার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কিন্তু স্বর্গের প্রকৃতিও যে সুন্দর, এমন কাল্পনিক তথ্য আমার জানা নেই। কাশ্মীরের সৌন্দর্যকে তুলনা করা স্বর্গের সাথে। কাশ্মীর কে বলা হয় ভূস্বর্গ। তাহলে ভুটানকে কী ডাকা হবে? নাম তার সুখী দেশ আছে বটে। কিন্তু তার সৌন্দর্যের জন্যও তো একটা নাম চাই। নাম হোক স্বর্গরাজ্য। এই স্বর্গরাজ্য তেই বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমি, আমাদের দুই ছেলে এবং তাদের পিতা।
ঢাকা থেকে নৈশকোচে বুড়ীমারি বর্ডার পর্যন্ত যাত্রাটি মন্দ না। ভালকরে ঘুমাতে পারলে একঘুমেই বুড়ীমারি। ট্রানজিট ভিসা দিয়ে ইন্ডিয়ার চেংড়াবন্দ বর্ডার পার হয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হলাম ভুটানের উদ্দেশ্যে। ইন্ডিয়ার কুচবিহারের জঙ্গল আর চা বাগানের পাশ দিয়ে জয়গা বর্ডার এ পৌঁছানোর এই পথটুকু স্বর্গরাজ্য প্রবেশের শুভ সুচনা। দুই আড়াই ঘন্টা পূর্বে পাসপোর্টে ভারত প্রবেশের সিল পড়েছে, জয়গা বর্ডার এ সিল পড়লো ভারত ত্যাগের। সামান্য একটু দুরেই ভুটান গেট এবং ফুলসলিং ইমিগ্রেশন অফিস। তিন চার ঘন্টার মধ্যে তিনটি দেশের অবস্থানের এই সড়ক পথে ভ্রমণের একটা আলাদা রোমান্টিকতা আছে বলেই বোধহয়।
ভুটান ভ্রমণে সার্ক বহির্ভূত দেশের নাগরিকদের জন্য স্থানীয় গাইড রাখা আইন। সার্কভুক্ত দেশের লোকদেরও গাইড রাখতে হয়। এরাই হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ভ্রমণের সব রকম দায়িত্ত্ব অত্যান্ত সুন্দরভাবে পালন করে। ড্রাইভাররা শিক্ষিত তাই তাদের উপরও একক ভাবে নির্ভর করা যায়। ভূটান প্রবেশের সব প্রক্রিয়া শেষ করতে বিকেল গড়িয়ে গেলো। এরপরে টাক্সি সহযোগে থিম্পু যাত্রা। পাহাড়ের দেশ। পাহাড়ী পথ কিন্তু সুব্যবস্থাপনার অত্যন্ত মসৃণ রাস্তা। সমতলের মানুষ আমরা গাড়ির জানালা দিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে পথ চলাইয় মন উৎফুল্লুতাই ভরে ওঠে। আমাদের সাথেই জেনো মেঘেরা ছুটে চলছে থিম্পুর উদ্দ্যশ্যে। থিম্পু পৌঁছাতে সাড়ে চার ঘন্টা লেগেছে। প্রতিমধ্যে রাতের খাবার টা খেয়ে নিলাম অত্যন্ত ঝিমঝাম, নিরিবিলি, ঘরোয়া পরিবেশের রেস্টুরেন্টে। তখনই জেনেছি অতিথি নিয়ে যাবার জন্য ড্রাইভারের খাবার টা রেস্টুরেন্ট ফ্রি দেই। থিম্পু পৌঁছালাম রাত সাড়ে নয়টায় ড্রাইভের মাধ্যমে বুকিং দেওয়া হোটেলে। ডিসেম্বরের শেষ পক্ষ, ভুটানে শীত তখন একেবারে জাকিয়ে বসেছে। রাতের শুরুতেই তাপমাত্রা থাকে ২/৩ ডিগ্রী, এবং মধ্যরাতে শূন্য।
পরেরদিন সকাল ১০ টা থেকে শুরু হলো আমাদের থিম্পু নগর ভ্রমণ। “সিমপ্লী ভুটান ” একটি আয়োজন। যেখানে গ্রামীন ভুটান প্রদর্শিত হয় এক ঝাক তরুন তরুনীর উপস্থাপনায়। আপ্যায়নে, বর্ণনায়, গানে, নৃত্যে, নাটকিয়তায় চলতে থাকে তাদের পারফরমেন্স। খুব সুন্দর, শান্ত একটা সময়। এর পরের গন্তব্য বিশাল বুদ্ধমূর্তি দর্শন। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পথ চলা। দুদিন আগের তুষারপাতের বরফ জমে আছে পথের পাশে, পাহাড়ের গায়ে। ভুটানের দর্শনীয় স্থান গুলোতে (সমগ্র ভুটনা ই তো দর্শনীয়) পৌঁছেই একটা হুরাহুরিতে মেতে উঠতে হয়। অভাবনীয় সৌন্দর্য দর্শনের বিস্ময় কাটিয়ে উটতেই সময়ের টানাটানি তে পড়ে যেতে হয় সবকিছু উপভোগে, স্মৃতিধরে রাখতে ছবি তোলার ব্যাস্ততায়। সুস্থির সময় মেলে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে, এক শহর থেকে আর এক শহরে। পাহাড়ের রাস্তা, তবে রাষ্ট্রের ব্যবস্থায় অত্যন্ত মসৃণ সে রাস্তা। নিজেদের মতো করে নেওয়া গাড়ি চলে দক্ষ ড্রাইভিং এ। গাড়ির জানালা দিয়ে তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যাই। মন তখন অবস্থান করে উচ্চতায়। পাহাড়, পাহাড় আর পাহাড়। কোনটি বরফে ঢাকা সাদা, কোনটি আবার সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে। কোনটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে বরফ গুলি যেন মনে হয় শিমুল তুলা। কোথাও মেঘ এশে সোহাগে ঢেকে দিয়েছে পাহাড়ের সরীরটিকে। ভুটানের পাহাড় গুলকে যেনো ঠিক কঠিন মনে হয় না। বিশালতার মাঝে যেনো ছোট ছোট, মিষ্টি মিষ্টি সৌন্দর্য বিলায়। বিশাল বিশাল বৃক্ষে ছোট ছোট রঙ্গিন ফুল যেমন ফুটে থাকে।
বুদ্ধমূর্তি ও মন্দিরের কাছে গিয়ে আমরা মুগ্ধ। বিশাল এক বুদ্ধমূর্তি এবং সেই বুদ্ধমূর্তি ঘিরে আরো প্রায় বিষ পঁচিশ টি একই চেহারা, একই ভঙ্গির অত্যন্ত সুন্দর নারী মূর্তি দেখে তো আমরা মুগ্ধ হয়েছি, সেই সাথে মুগ্ধ হয়েছি পরিবেশটি দেখে। চারিদিকে পাহাড় বেষ্টিত একটি উন্মুক্ত স্থানে বুদ্ধমূর্তি গুলো স্থাপিত। বিশাল পাহাড়, বিশাল মূর্তি, উন্মুক্ত আকাশ এমন একটা পরিবেশে আমাদের মন টা কে ভরিয়ে দিলো এক অপার প্রাপ্তিতে।
দুপুরে দক্ষিন ভারতের একাটা রেষ্টুরেন্টে আমারা খাবার খেলাম। রৌদ্রোজ্জল দুপুরের পরে ছায়াময় অপরাহ্ণ। শীতের তিব্রতা তখন কেবলই বাড়ছে। খুবই ছোট পরিষরে একটা চিড়িয়াখানার গেটে একটু উঁকি দিয়ে আমরা গেলাম একটা পিক পয়েন্টে। খুব কাছে গিয়ে বুদ্ধ মূর্তি দেখে এসেছি। তবে এই পিকপয়েন্ট থেকে দূরে পাহাড়ের মাঝে বুদ্ধমূর্তির একটা আলাদা সৌন্দর্য চোখ জুড়িয়ে দেয়। ততক্ষনে তাপমাত্রা কেবলই নিছের দিকে নামছে। আছে শীতল বাতাশ। রাতের খাবার খেয়ে হোটেলের রুমে ফিরলাম। রাত তখন ও অতো বেশী হয়নি। কিন্তু রমে ফিরে শীতের তীব্রতাই আর কিছু করা সম্ভব না। খুব ঝটপট ফ্রেশ হয়ে সোজা বিছানায়।
পরের দিনের গন্তব্য দোচুলা পাশ এবং পুনাখা। তবে ওখান থেকে আর থিম্পু ফেরা নয়, যাওয়া হবে পারো। ওখানের হোটেলে থাকা হবে। পুনাখা, পারো যেতে থিম্পু থেকে পারমিশন নিয়ে যেতে হবে। শুরু হলো আমাদের তৃতীয় দিনের ভ্রমন মসৃন পাহাড়ী পথ জুড়ে। পৌঁছে গেলাম দোচলা পাশে। এ আমরা কোথায় এলাম! বিস্ময়ে আমরা হতবাক। আকাশের বুকে ভেসে আছে হিমালয়ের কয়েকটি চূড়া। পাহাড়ের সে চূড়াগুলো মেঘ আর রৌদ্রর সাথে মিলে যে অভাবনীয় দৃশ্যপটের অবতারণা করছিল তা বর্ননা করার ভাষা নেই আমার। দোচুলার যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে সেখানে স্তুপ হয়ে আছে কয়েকদিন পূর্বে তুষারপাতের বরফকুচি। এই দুই অপার সৌন্দর্য একই সময়ে উপভোগে আমাদের তখন দিশেহারা অবস্থা। ওই জায়গা থেকে আমরা কিছুতেই বের হতে পারছিলাম না। তবুও ছুটতে হলো পরবর্তী গন্তব্য পুনাখা জং-এ। একটি অপ্রসস্থ নদী একটি কাঠের সাঁকোর উপর দিয়ে পার হলেই পুনাখা জং। তবে এই নদীটির দিকে তাকিয়ে পার করে দেয়া যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। অগভীর তবে স্রোতস্বিনী নদী । নূরী পাথরের স্পর্শে স্বচ্ছতা নিয়ে ছুটে চলছে উচ্চস্বরে। সূর্যের কিরনে অত্যন্ত স্বচ্ছ এই জলধারা চিকচিক করে উঠছে। কলকল শব্দে চলছে নদীটি। ইচ্ছে করছিল না এখান থেকে চোখ ফেরাতে। এই অপ্রস্থ নদীটির উপর দিয়ে ছোট্ট একটি পুল। পুলের ওপাশে পুনাখা জং । বহু পুরাতন বাড়ী। দেয়াল, সিলিং, দরজা, জানালা সর্বত্র খুব সূক্ষ্ম কারুকাজ করা। বুদ্ধ এবং আরেকজন গুরুর বড় মূর্তি আছে মন্দিরে। এখান থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম ঝুলন্ত ব্রীজ দেখতে। ব্রীজে দাঁড়িয়ে স্রোতস্বিনী নদীর কলকল রব, শীতল বাতাস, গোধলীলগ্নের পাহাড় দেখার শান্তি ছেড়ে ফিরে আসাটা কঠিন। একটা ঘরয়া রেস্ট্রুরেন্ট রাতের খাবার খেলাম। এখানে প্রধানত মেয়েরাই রেস্ট্রুরেন্ট চালায়। থিম্পু থেকে পুনাখা, পারোতে শীতের তীব্রতা বেশী। গাড়ীতে হিটার থাকায় রক্ষা। হিটারের উষ্ণতা নিয়ে অন্ধকারের পাহাড় উপভোগ করতে করতে এবং সেই সঙ্গে সারাদিনের বিস্ময়, আনন্দ, প্রকৃতি যা ক্যামেরায় বন্দি করা হয়েছে তা দেখতে থাকলাম। আর আমাদের গাড়ি ছুটে চলল পাহাড়ের মসৃন পথে পারোর উদ্দেশ্য। পারোর হোটেলে যখন পৌঁছালাম তখন ঘড়ির কাঁটা নয়টা ছাড়িয়ে গেছে। ও হ্যাঁ ভুটান আর বাংলাদেশের ঘড়ির সময় একই।
ভ্রমনের চতুর্থ দিনে আমাদের গন্তব্য পাঁচ মাইল উচ্চের পাহাড়ের চূড়ায় 'টাইগার নেস্ট' মন্দির। সকাল আটটায় আমরা হোটেল থেকে বের হলাম। দিনের আলোয় পারো। চারিদিকে পাহাড়। রাস্তার পাশ দিয়ে কলকল রবে চলেছে একটি অগভীর, অপ্রস্থ নদীর। পাহাড়ে ওঠার আগে আমরা একটি বাড়িতে নাস্তা করলাম। সকলে বাঁশের লাঠি কিনে নিয়ে রওনা হলাম। অনেক অভিযাত্রী। অনেক বৃদ্ধাকে দেখে ভেবে পাইনি কি করে এতটা পথ তারা পাড়ি দিবেন। তবে আশ্চর্য তারা ঠিকই পৌঁছে গেছেন গন্তব্যে। ওঠার সময় সিকি পথ ঘোড়ায় যাওয়া যায়। তবে নামার সময় ঘোড়া পাওয়া যায় না। দীর্ঘ পথ। পথ আর ফুরায় না। তবে কোন তাড়াহুড়া নেই। সকলে খুব আস্তে ধীরে হাঁটছে। ঠান্ডা আবহাওয়া তাই ক্লান্তি বোধ হয়না। চারিদিকে উচ্চ উচ্চ পাহাড়। কোনটায় বরফ জমে সাদা। কোনটা সূর্য্যের কিরণে চকচক করছে। যে মন্দির আমাদের শেষ গন্তব্য সেটি একটি গুহার মধ্যে। তবে গুহার মুখেই মন্দির তাই গুহার মধ্যে ঢুকেছি বলে ঠিক মনেহয়নি। মন্দিরের দোরগোড়ায় পাহাড়ের গা ঘেষে একটি ছোট্ট ঝর্ণা। অতি প্রাচীন মন্দির। মন্দির ঘুরে একই পথেই ফেরা। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়।
পঞ্চম দিনে আমরা পারো শহরটি ঘুরলাম। পারোর প্রায় সর্বত্রই একটি নদী বয়ে চলেছে। ভুটানের অন্য নদীর মতই এই নদীটি। অপ্রস্থ, অগভীর । ছোট ছোট পাথরের উপর দিয়ে কলকল রবে ছুটে চলে। খুব স্বচ্ছ জলধারা। আমরা প্রথমেই গেলাম একটি সুন্দর নিরিবিলি এলাকা। সেখানে ভুটানের জাতীয় পোশাক ভাড়া করে বড় ছেলেকে পড়িয়ে আমরা একটা কাঠের ব্রীজে নদীর স্বাদ নিলাম আবার । একটা ছোট আর্ট গ্যালারী ঘুরলাম। এরপরে আমরা গেলাম একটু দূরে থেকে এয়ারপোর্ট দেখতে। মূলত রানওয়েটাই দেখলাম। এটি পৃথিবীর দশটি বিপদজনক এয়ারপোর্টের একটি। দুই পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে উড়োজাহাজের চলাচল। ভুটানের নিজস্ব এয়ারক্রাফটই এখানে একমাত্র বাহন। খুব দক্ষ পাইলটের দক্ষ চালনায় এখানে কখনও কোন দুর্ঘটনা ঘটে নি। এর পরে যে উঁচু পিকে গেলাম সেখানেও রানওয়েটা দেখা যায়। এই উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে পাহাড় দর্শন এবং রানওয়ে দেখার সময়টা খুব নির্মল । এর পর দুটো জং বাইরে থেকে দেখে আমরা ভুটানের জাতীয় যাদুঘরে গেলাম। খুবই ছোট জাদুঘর। খুব বেশী দেখারও কিছু নেই। অত ছোট জাদুঘরেই একটু বেশী জায়গা নিয়ে আছে একটি ফটো গ্যালারি - ইন্ডিয়া ও ভুটানের বিভিন্ন সময়ের রাষ্ট্র প্রধানদের বন্ধুত্বের ফটোগ্রাফ। সন্ধ্যাটা কাটালাম বিপণী বিতানে। অনেক সুন্দর সুন্দর শৈল্পিক দ্রব্যাদি পাওয়া যায় । বেশির ভাগই অত্যন্ত দামী। তবে এরা ইউরোপিয়ানদের জন্য সব জিনিসের দাম বেশি রাখে। এই উপমহাদেশের জন্য দামটা খানিকটা কম রাখে। এর পরেও দরকষাকষি করলে তারা রেগে যায়।
ষষ্ঠ দিন। আমাদের বিদাযের দিন। ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমরা যাত্রা শুরু করলাম। তাপমাত্রা তখন কেবল শুন্য থেকে এক- এ উঠেছে। গাড়ীর হিটারই ভরসা। গাড়ী ছুটে চলল মসৃন পথে। ধীরে ধীরে আলো উঠছে। শেষবারের মত পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে নিলাম। রাস্তার একদম কাছেই একটি স্রোতস্বিনী ঝর্না। আমাদের ড্রাইভার ভাই নেমে ঝর্ণার জলে হাতমুখ ধুয়ে নিলেন। এত কাছে এমন একটা ঝর্ণা দেখে খুব ভাল লাগছিল। কিন্তু শীতের তীব্রতায় এবং বিদায়ের বিষণ্নতায় গাড়ী থেকে নেমে দেখার ভাবনাটা মনে আসল না।
ফুলসলিং বর্ডারে পৌঁছলাম সাড়ে দশটায়। আরেকটি তথ্য, ভুটানের ছোট ছোট দোকান, রেস্ট্রুরেন্ট, রাস্তার বিলবোর্ডে, মন্দিরে সর্বত্র রাজা রানীর ছবি। এমনকি শিশু রাজপুত্রেরও। ভুটানীরা বলে এটা তাদের ভক্তি, ভালবাসা। অলিখিত নিয়ম কিনা সেটা আবিষ্কার করতে পারলাম বা। ভুটান ভ্রমন শেষে বর্ডারে এসে আমরা ড্রাইভার ভাইয়ের পারিশ্রমিক মিটালাম অসীম কৃতজ্ঞতায়, বিদায়ের বিষণ্নতায়। এর আগে তাকে কেবল হোটেল ভাড়া ছাড়া আর একটা রুপিও দিতে হয়নি। ভুটানে ইন্ডিয়ান রুপি এবং ভুটানের রুপি সমানভাবেই চলে।
এই ফুলসলিং বর্ডার থেকে যখনই বের হয়ে চলে আসছিলাম ইন্ডিয়ার দিকে তখনই যেনো মনে হচ্ছিলো পিছন থেকে সম্পূর্ণ সুন্দর সেই দেশ, সেই পাহাড়, সেই নদী, সেই প্রকৃ্তি , সেই অপরুপ সবুজ স্বপ্নময় দেশ আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ভুটানকে বিদায় বলে ভুটানের ড্রাইভার ভাইয়ের ঠিক করে দেওয়া ইন্ডিয়ান গাড়ীতে উঠলাম। জয়গা বর্ডারে এন্ট্রি নিয়ে চেংড়াবন্দ বর্ডার দিয়ে একজিট করবো। গাড়ীতে উঠতেই হাসিখুসই ইন্ডিয়ান বাঙ্গালী বলল, কাকু এক হাজার রূপি দাও তেল ভরতে হবে।
স্বর্গে অনেক আরামে থাকার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কিন্তু স্বর্গের প্রকৃতিও যে সুন্দর, এমন কাল্পনিক তথ্য আমার জানা নেই। কাশ্মীরের সৌন্দর্যকে তুলনা করা স্বর্গের সাথে। কাশ্মীর কে বলা হয় ভূস্বর্গ। তাহলে ভুটানকে কী ডাকা হবে? নাম তার সুখী দেশ আছে বটে। কিন্তু তার সৌন্দর্যের জন্যও তো একটা নাম চাই। নাম হোক স্বর্গরাজ্য। এই স্বর্গরাজ্য তেই বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমি, আমাদের দুই ছেলে এবং তাদের পিতা।
ঢাকা থেকে নৈশকোচে বুড়ীমারি বর্ডার পর্যন্ত যাত্রাটি মন্দ না। ভালকরে ঘুমাতে পারলে একঘুমেই বুড়ীমারি। ট্রানজিট ভিসা দিয়ে ইন্ডিয়ার চেংড়াবন্দ বর্ডার পার হয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হলাম ভুটানের উদ্দেশ্যে। ইন্ডিয়ার কুচবিহারের জঙ্গল আর চা বাগানের পাশ দিয়ে জয়গা বর্ডার এ পৌঁছানোর এই পথটুকু স্বর্গরাজ্য প্রবেশের শুভ সুচনা। দুই আড়াই ঘন্টা পূর্বে পাসপোর্টে ভারত প্রবেশের সিল পড়েছে, জয়গা বর্ডার এ সিল পড়লো ভারত ত্যাগের। সামান্য একটু দুরেই ভুটান গেট এবং ফুলসলিং ইমিগ্রেশন অফিস। তিন চার ঘন্টার মধ্যে তিনটি দেশের অবস্থানের এই সড়ক পথে ভ্রমণের একটা আলাদা রোমান্টিকতা আছে বলেই বোধহয়।
ভুটান ভ্রমণে সার্ক বহির্ভূত দেশের নাগরিকদের জন্য স্থানীয় গাইড রাখা আইন। সার্কভুক্ত দেশের লোকদেরও গাইড রাখতে হয়। এরাই হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ভ্রমণের সব রকম দায়িত্ত্ব অত্যান্ত সুন্দরভাবে পালন করে। ড্রাইভাররা শিক্ষিত তাই তাদের উপরও একক ভাবে নির্ভর করা যায়। ভূটান প্রবেশের সব প্রক্রিয়া শেষ করতে বিকেল গড়িয়ে গেলো। এরপরে টাক্সি সহযোগে থিম্পু যাত্রা। পাহাড়ের দেশ। পাহাড়ী পথ কিন্তু সুব্যবস্থাপনার অত্যন্ত মসৃণ রাস্তা। সমতলের মানুষ আমরা গাড়ির জানালা দিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে পথ চলাইয় মন উৎফুল্লুতাই ভরে ওঠে। আমাদের সাথেই জেনো মেঘেরা ছুটে চলছে থিম্পুর উদ্দ্যশ্যে। থিম্পু পৌঁছাতে সাড়ে চার ঘন্টা লেগেছে। প্রতিমধ্যে রাতের খাবার টা খেয়ে নিলাম অত্যন্ত ঝিমঝাম, নিরিবিলি, ঘরোয়া পরিবেশের রেস্টুরেন্টে। তখনই জেনেছি অতিথি নিয়ে যাবার জন্য ড্রাইভারের খাবার টা রেস্টুরেন্ট ফ্রি দেই। থিম্পু পৌঁছালাম রাত সাড়ে নয়টায় ড্রাইভের মাধ্যমে বুকিং দেওয়া হোটেলে। ডিসেম্বরের শেষ পক্ষ, ভুটানে শীত তখন একেবারে জাকিয়ে বসেছে। রাতের শুরুতেই তাপমাত্রা থাকে ২/৩ ডিগ্রী, এবং মধ্যরাতে শূন্য।
পরেরদিন সকাল ১০ টা থেকে শুরু হলো আমাদের থিম্পু নগর ভ্রমণ। “সিমপ্লী ভুটান ” একটি আয়োজন। যেখানে গ্রামীন ভুটান প্রদর্শিত হয় এক ঝাক তরুন তরুনীর উপস্থাপনায়। আপ্যায়নে, বর্ণনায়, গানে, নৃত্যে, নাটকিয়তায় চলতে থাকে তাদের পারফরমেন্স। খুব সুন্দর, শান্ত একটা সময়। এর পরের গন্তব্য বিশাল বুদ্ধমূর্তি দর্শন। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পথ চলা। দুদিন আগের তুষারপাতের বরফ জমে আছে পথের পাশে, পাহাড়ের গায়ে। ভুটানের দর্শনীয় স্থান গুলোতে (সমগ্র ভুটনা ই তো দর্শনীয়) পৌঁছেই একটা হুরাহুরিতে মেতে উঠতে হয়। অভাবনীয় সৌন্দর্য দর্শনের বিস্ময় কাটিয়ে উটতেই সময়ের টানাটানি তে পড়ে যেতে হয় সবকিছু উপভোগে, স্মৃতিধরে রাখতে ছবি তোলার ব্যাস্ততায়। সুস্থির সময় মেলে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে, এক শহর থেকে আর এক শহরে। পাহাড়ের রাস্তা, তবে রাষ্ট্রের ব্যবস্থায় অত্যন্ত মসৃণ সে রাস্তা। নিজেদের মতো করে নেওয়া গাড়ি চলে দক্ষ ড্রাইভিং এ। গাড়ির জানালা দিয়ে তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যাই। মন তখন অবস্থান করে উচ্চতায়। পাহাড়, পাহাড় আর পাহাড়। কোনটি বরফে ঢাকা সাদা, কোনটি আবার সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে। কোনটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে বরফ গুলি যেন মনে হয় শিমুল তুলা। কোথাও মেঘ এশে সোহাগে ঢেকে দিয়েছে পাহাড়ের সরীরটিকে। ভুটানের পাহাড় গুলকে যেনো ঠিক কঠিন মনে হয় না। বিশালতার মাঝে যেনো ছোট ছোট, মিষ্টি মিষ্টি সৌন্দর্য বিলায়। বিশাল বিশাল বৃক্ষে ছোট ছোট রঙ্গিন ফুল যেমন ফুটে থাকে।
বুদ্ধমূর্তি ও মন্দিরের কাছে গিয়ে আমরা মুগ্ধ। বিশাল এক বুদ্ধমূর্তি এবং সেই বুদ্ধমূর্তি ঘিরে আরো প্রায় বিষ পঁচিশ টি একই চেহারা, একই ভঙ্গির অত্যন্ত সুন্দর নারী মূর্তি দেখে তো আমরা মুগ্ধ হয়েছি, সেই সাথে মুগ্ধ হয়েছি পরিবেশটি দেখে। চারিদিকে পাহাড় বেষ্টিত একটি উন্মুক্ত স্থানে বুদ্ধমূর্তি গুলো স্থাপিত। বিশাল পাহাড়, বিশাল মূর্তি, উন্মুক্ত আকাশ এমন একটা পরিবেশে আমাদের মন টা কে ভরিয়ে দিলো এক অপার প্রাপ্তিতে।
দুপুরে দক্ষিন ভারতের একাটা রেষ্টুরেন্টে আমারা খাবার খেলাম। রৌদ্রোজ্জল দুপুরের পরে ছায়াময় অপরাহ্ণ। শীতের তিব্রতা তখন কেবলই বাড়ছে। খুবই ছোট পরিষরে একটা চিড়িয়াখানার গেটে একটু উঁকি দিয়ে আমরা গেলাম একটা পিক পয়েন্টে। খুব কাছে গিয়ে বুদ্ধ মূর্তি দেখে এসেছি। তবে এই পিকপয়েন্ট থেকে দূরে পাহাড়ের মাঝে বুদ্ধমূর্তির একটা আলাদা সৌন্দর্য চোখ জুড়িয়ে দেয়। ততক্ষনে তাপমাত্রা কেবলই নিছের দিকে নামছে। আছে শীতল বাতাশ। রাতের খাবার খেয়ে হোটেলের রুমে ফিরলাম। রাত তখন ও অতো বেশী হয়নি। কিন্তু রমে ফিরে শীতের তীব্রতাই আর কিছু করা সম্ভব না। খুব ঝটপট ফ্রেশ হয়ে সোজা বিছানায়।
পরের দিনের গন্তব্য দোচুলা পাশ এবং পুনাখা। তবে ওখান থেকে আর থিম্পু ফেরা নয়, যাওয়া হবে পারো। ওখানের হোটেলে থাকা হবে। পুনাখা, পারো যেতে থিম্পু থেকে পারমিশন নিয়ে যেতে হবে। শুরু হলো আমাদের তৃতীয় দিনের ভ্রমন মসৃন পাহাড়ী পথ জুড়ে। পৌঁছে গেলাম দোচলা পাশে। এ আমরা কোথায় এলাম! বিস্ময়ে আমরা হতবাক। আকাশের বুকে ভেসে আছে হিমালয়ের কয়েকটি চূড়া। পাহাড়ের সে চূড়াগুলো মেঘ আর রৌদ্রর সাথে মিলে যে অভাবনীয় দৃশ্যপটের অবতারণা করছিল তা বর্ননা করার ভাষা নেই আমার। দোচুলার যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে সেখানে স্তুপ হয়ে আছে কয়েকদিন পূর্বে তুষারপাতের বরফকুচি। এই দুই অপার সৌন্দর্য একই সময়ে উপভোগে আমাদের তখন দিশেহারা অবস্থা। ওই জায়গা থেকে আমরা কিছুতেই বের হতে পারছিলাম না। তবুও ছুটতে হলো পরবর্তী গন্তব্য পুনাখা জং-এ। একটি অপ্রসস্থ নদী একটি কাঠের সাঁকোর উপর দিয়ে পার হলেই পুনাখা জং। তবে এই নদীটির দিকে তাকিয়ে পার করে দেয়া যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। অগভীর তবে স্রোতস্বিনী নদী । নূরী পাথরের স্পর্শে স্বচ্ছতা নিয়ে ছুটে চলছে উচ্চস্বরে। সূর্যের কিরনে অত্যন্ত স্বচ্ছ এই জলধারা চিকচিক করে উঠছে। কলকল শব্দে চলছে নদীটি। ইচ্ছে করছিল না এখান থেকে চোখ ফেরাতে। এই অপ্রস্থ নদীটির উপর দিয়ে ছোট্ট একটি পুল। পুলের ওপাশে পুনাখা জং । বহু পুরাতন বাড়ী। দেয়াল, সিলিং, দরজা, জানালা সর্বত্র খুব সূক্ষ্ম কারুকাজ করা। বুদ্ধ এবং আরেকজন গুরুর বড় মূর্তি আছে মন্দিরে। এখান থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম ঝুলন্ত ব্রীজ দেখতে। ব্রীজে দাঁড়িয়ে স্রোতস্বিনী নদীর কলকল রব, শীতল বাতাস, গোধলীলগ্নের পাহাড় দেখার শান্তি ছেড়ে ফিরে আসাটা কঠিন। একটা ঘরয়া রেস্ট্রুরেন্ট রাতের খাবার খেলাম। এখানে প্রধানত মেয়েরাই রেস্ট্রুরেন্ট চালায়। থিম্পু থেকে পুনাখা, পারোতে শীতের তীব্রতা বেশী। গাড়ীতে হিটার থাকায় রক্ষা। হিটারের উষ্ণতা নিয়ে অন্ধকারের পাহাড় উপভোগ করতে করতে এবং সেই সঙ্গে সারাদিনের বিস্ময়, আনন্দ, প্রকৃতি যা ক্যামেরায় বন্দি করা হয়েছে তা দেখতে থাকলাম। আর আমাদের গাড়ি ছুটে চলল পাহাড়ের মসৃন পথে পারোর উদ্দেশ্য। পারোর হোটেলে যখন পৌঁছালাম তখন ঘড়ির কাঁটা নয়টা ছাড়িয়ে গেছে। ও হ্যাঁ ভুটান আর বাংলাদেশের ঘড়ির সময় একই।
ভ্রমনের চতুর্থ দিনে আমাদের গন্তব্য পাঁচ মাইল উচ্চের পাহাড়ের চূড়ায় 'টাইগার নেস্ট' মন্দির। সকাল আটটায় আমরা হোটেল থেকে বের হলাম। দিনের আলোয় পারো। চারিদিকে পাহাড়। রাস্তার পাশ দিয়ে কলকল রবে চলেছে একটি অগভীর, অপ্রস্থ নদীর। পাহাড়ে ওঠার আগে আমরা একটি বাড়িতে নাস্তা করলাম। সকলে বাঁশের লাঠি কিনে নিয়ে রওনা হলাম। অনেক অভিযাত্রী। অনেক বৃদ্ধাকে দেখে ভেবে পাইনি কি করে এতটা পথ তারা পাড়ি দিবেন। তবে আশ্চর্য তারা ঠিকই পৌঁছে গেছেন গন্তব্যে। ওঠার সময় সিকি পথ ঘোড়ায় যাওয়া যায়। তবে নামার সময় ঘোড়া পাওয়া যায় না। দীর্ঘ পথ। পথ আর ফুরায় না। তবে কোন তাড়াহুড়া নেই। সকলে খুব আস্তে ধীরে হাঁটছে। ঠান্ডা আবহাওয়া তাই ক্লান্তি বোধ হয়না। চারিদিকে উচ্চ উচ্চ পাহাড়। কোনটায় বরফ জমে সাদা। কোনটা সূর্য্যের কিরণে চকচক করছে। যে মন্দির আমাদের শেষ গন্তব্য সেটি একটি গুহার মধ্যে। তবে গুহার মুখেই মন্দির তাই গুহার মধ্যে ঢুকেছি বলে ঠিক মনেহয়নি। মন্দিরের দোরগোড়ায় পাহাড়ের গা ঘেষে একটি ছোট্ট ঝর্ণা। অতি প্রাচীন মন্দির। মন্দির ঘুরে একই পথেই ফেরা। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়।
পঞ্চম দিনে আমরা পারো শহরটি ঘুরলাম। পারোর প্রায় সর্বত্রই একটি নদী বয়ে চলেছে। ভুটানের অন্য নদীর মতই এই নদীটি। অপ্রস্থ, অগভীর । ছোট ছোট পাথরের উপর দিয়ে কলকল রবে ছুটে চলে। খুব স্বচ্ছ জলধারা। আমরা প্রথমেই গেলাম একটি সুন্দর নিরিবিলি এলাকা। সেখানে ভুটানের জাতীয় পোশাক ভাড়া করে বড় ছেলেকে পড়িয়ে আমরা একটা কাঠের ব্রীজে নদীর স্বাদ নিলাম আবার । একটা ছোট আর্ট গ্যালারী ঘুরলাম। এরপরে আমরা গেলাম একটু দূরে থেকে এয়ারপোর্ট দেখতে। মূলত রানওয়েটাই দেখলাম। এটি পৃথিবীর দশটি বিপদজনক এয়ারপোর্টের একটি। দুই পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে উড়োজাহাজের চলাচল। ভুটানের নিজস্ব এয়ারক্রাফটই এখানে একমাত্র বাহন। খুব দক্ষ পাইলটের দক্ষ চালনায় এখানে কখনও কোন দুর্ঘটনা ঘটে নি। এর পরে যে উঁচু পিকে গেলাম সেখানেও রানওয়েটা দেখা যায়। এই উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে পাহাড় দর্শন এবং রানওয়ে দেখার সময়টা খুব নির্মল । এর পর দুটো জং বাইরে থেকে দেখে আমরা ভুটানের জাতীয় যাদুঘরে গেলাম। খুবই ছোট জাদুঘর। খুব বেশী দেখারও কিছু নেই। অত ছোট জাদুঘরেই একটু বেশী জায়গা নিয়ে আছে একটি ফটো গ্যালারি - ইন্ডিয়া ও ভুটানের বিভিন্ন সময়ের রাষ্ট্র প্রধানদের বন্ধুত্বের ফটোগ্রাফ। সন্ধ্যাটা কাটালাম বিপণী বিতানে। অনেক সুন্দর সুন্দর শৈল্পিক দ্রব্যাদি পাওয়া যায় । বেশির ভাগই অত্যন্ত দামী। তবে এরা ইউরোপিয়ানদের জন্য সব জিনিসের দাম বেশি রাখে। এই উপমহাদেশের জন্য দামটা খানিকটা কম রাখে। এর পরেও দরকষাকষি করলে তারা রেগে যায়।
ষষ্ঠ দিন। আমাদের বিদাযের দিন। ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমরা যাত্রা শুরু করলাম। তাপমাত্রা তখন কেবল শুন্য থেকে এক- এ উঠেছে। গাড়ীর হিটারই ভরসা। গাড়ী ছুটে চলল মসৃন পথে। ধীরে ধীরে আলো উঠছে। শেষবারের মত পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে নিলাম। রাস্তার একদম কাছেই একটি স্রোতস্বিনী ঝর্না। আমাদের ড্রাইভার ভাই নেমে ঝর্ণার জলে হাতমুখ ধুয়ে নিলেন। এত কাছে এমন একটা ঝর্ণা দেখে খুব ভাল লাগছিল। কিন্তু শীতের তীব্রতায় এবং বিদায়ের বিষণ্নতায় গাড়ী থেকে নেমে দেখার ভাবনাটা মনে আসল না।
ফুলসলিং বর্ডারে পৌঁছলাম সাড়ে দশটায়। আরেকটি তথ্য, ভুটানের ছোট ছোট দোকান, রেস্ট্রুরেন্ট, রাস্তার বিলবোর্ডে, মন্দিরে সর্বত্র রাজা রানীর ছবি। এমনকি শিশু রাজপুত্রেরও। ভুটানীরা বলে এটা তাদের ভক্তি, ভালবাসা। অলিখিত নিয়ম কিনা সেটা আবিষ্কার করতে পারলাম বা। ভুটান ভ্রমন শেষে বর্ডারে এসে আমরা ড্রাইভার ভাইয়ের পারিশ্রমিক মিটালাম অসীম কৃতজ্ঞতায়, বিদায়ের বিষণ্নতায়। এর আগে তাকে কেবল হোটেল ভাড়া ছাড়া আর একটা রুপিও দিতে হয়নি। ভুটানে ইন্ডিয়ান রুপি এবং ভুটানের রুপি সমানভাবেই চলে।
এই ফুলসলিং বর্ডার থেকে যখনই বের হয়ে চলে আসছিলাম ইন্ডিয়ার দিকে তখনই যেনো মনে হচ্ছিলো পিছন থেকে সম্পূর্ণ সুন্দর সেই দেশ, সেই পাহাড়, সেই নদী, সেই প্রকৃ্তি , সেই অপরুপ সবুজ স্বপ্নময় দেশ আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ভুটানকে বিদায় বলে ভুটানের ড্রাইভার ভাইয়ের ঠিক করে দেওয়া ইন্ডিয়ান গাড়ীতে উঠলাম। জয়গা বর্ডারে এন্ট্রি নিয়ে চেংড়াবন্দ বর্ডার দিয়ে একজিট করবো। গাড়ীতে উঠতেই হাসিখুসই ইন্ডিয়ান বাঙ্গালী বলল, কাকু এক হাজার রূপি দাও তেল ভরতে হবে।
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.