ডেলিকেট আর্চের পিছনে বরফের চাদরে মোড়া লা সল্ মাউন্টেন।
গোটা আমেরিকা যখন ‘থ্যাঙ্কস গিভিং’ নিয়ে ব্যস্ত, তেমনই একটা সময়ে আমরা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য আগেই থেকেই ঠিক করা ছিল, উটাহ-এর আর্চেস ন্যাশনাল পার্ক।
লস অ্যাঞ্জেলস থেকে অ্যারিজোনার পেজ হয়ে সিনিক বাইওয়ে-১২ ধরে মোয়াবের দিকে রওনা দিলাম। উটাহর পূর্বদিকের এক শহর এই মোয়াব। আসলে এই শহর আর্চেস ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশপথও।সিনিক বাইওয়ে ধরে এগোলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর রুট-৬৬, রেড ক্যানিয়ন, ডিক্সি ন্যাশনাল ফরেস্ট, ব্রাইস ক্যানিয়ন, ক্যাপিটাল রিফ, গ্র্যান্ড স্টাইল কেসএসকালান্তে পেরিয়ে আসতে হয়।
এর মধ্যে ব্রাইস ক্যানিয়ন ভীষণই সুন্দর। সময়ের তোয়াক্কা না করে তাই যাওয়ার ফাঁকে এক চক্কর কেটে নিলাম ব্রাইসে।ব্রাইসে ঢোকার মুখে দুটো রেড ক্যানিয়ন আর্চ রয়েছে। রাজস্থানের কেল্লায় ঢোকার মুখে যেমন বিশাল ফটক থাকে, ঠিক তেমনই। নভেম্বরে রাস্তার দু’পাশে পেঁজা তুলোর মতো বরফের পাহাড় জমেছে। হাতছানি এড়ানো গেল না!
বরফে ঢাকা বলে আমরা আর হাইকিং পথে গেলাম না। হুডুজের ছবি ক্যামেরাবন্দি করে বেরিয়ে পড়লাম।
দুপুর ৩টে নাগাদ বাইওয়ে-১২তে গিয়ে পড়লাম। রাস্তার দু’পাশের ভৌগলিক সৌন্দর্য এককথায় অনবদ্য! সে সব দেখতে দেখতেই এগোতে থাকলাম। গ্র্যান্ড স্টেয়ারকেসে এসকালান্তে যেন প্রকৃতির আঁকা সিঁড়ি। দূর থেকে তাকে বিদায় জানিয়েই এগোলাম। সময় কম থাকায় দক্ষিণ উটাহর অন্যতম জনপ্রিয় ক্যাপিটল রিফ ন্যাশনাল পার্কে আর যাওয়া হল না।
তুষারাবৃত ব্রাইস
সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। নভেম্বরের মোয়াবে তখনও তুষারপাত সেভাবে শুরু হয়নি। তবে হাড়কাঁপানো হাওয়া বইছে।ঠান্ডা আর দূষণহীন অক্সিজেনে আগের দিনের ক্লান্তিটা যেন অনেকটাই কমে গেল। ডেনিসে ব্রেকফাস্ট সেরে, প্যাকেটে লাঞ্চ ভরে আর্চেস পার্কের ভিজিটর সেন্টারে পৌঁছলাম।
সাড়ে ৮টাতেই ছোট লাইন পড়ে গিয়েছে পার্কের গেটের সামনে। ২৫ ডলার এন্ট্রান্স ফি। ঢুকে পড়লাম পার্কের ভিতরে। ভিজিটর সেন্টার হয়ে ডান দিকে বেঁকে যাওয়া রাস্তা ধরে এগোনো গেল। সেখানে নানা উচ্চতার প্রায় ২ হাজার বালি–পাথরের মনোলিথ এবং আর্চ নজরে পড়ল। পার্কটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪ হাজার ফুট উঁচুতে। আসলে এক মরুভূমি।হাজার হাজার বছর আগে গোটা অঞ্চলটি সমুদ্রের নীচে ছিল। জল শুকিয়ে লবণযুক্ত শিলা ক্ষয়ে গিয়ে আর্চগুলো তৈরি হয়েছে।
লবণযুক্ত শিলা ক্ষয়ে এমন আর্চ তৈরি হয়েছে
খনিজ সম্পদে ভরপুর এই জায়গাটার প্রথম সন্ধান পেয়েছিলেন আলেকজান্ডার রিংফার। সেই ১৯২০থেকে সম্পূর্ণ ভাবে নিজের উদ্যোগে এই জায়গা নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে শুরু করেন তিনি।তাঁর হাত ধরেই পর্যটকরা ভিড় জমাতে শুরু করেন। ১৯২৯-এ ৩১তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুভার আর্চেস ন্যাশনাল মনুমেন্টটি স্থাপন করেন। পরে ১৯৭১-এএটি ন্যাশনাল পার্ক হয়ে ওঠে।
কিছুটা এগিয়ে চোখে পড়ল থ্রি গসিপস। লাল পাথরের তিনটি মনোলিথ পরপর এমন ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে, দেখলে মনে হবে তিনটি মেয়ে দাঁড়িয়ে পরচর্চা করছে!মূল রাস্তাটার একদম পাশে ব্যালান্সড রক। ভারসাম্য বজায় রেখে একটি বোল্ডারের উপর আর একটি পাথর অদ্ভুত ভাবে দাঁড়িয়ে।পার্কের সমস্ত শিলাস্তম্ভগুলোর মধ্যে ব্যালান্সড রক সবচেয়ে জনপ্রিয়।
পয়েন্ট প্যানোরামা ভিউ হয়ে ডেলিকেট আর্চ যাওয়ার সময়েই লাঞ্চটা সেরে ফেললাম। গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরের আকর্ষণীয় জগৎ দেখতে দেখতে পৌঁছলাম ডেলিকেট আর্চের ট্রেল হেডের সামনে।ডেলিকেট আর্চের দুটো ভিউ পয়েন্ট— আপার এবং লোয়ার। আপার ভিউপয়েন্ট অসম্ভব জনপ্রিয়। পাহাড়ের খাড়া রাস্তা ধরে হাইকিংয়ের পথ। তবে, লোয়ার ভিউ পয়েন্ট সমতলে। ডেলিকেট আর্চটি এখান থেকে অনেকটা দূরের লাগে, তাই এর জনপ্রিয়তা কিছুটা কম।
আমরা তাই আপার ভিউপয়েন্ট যাব। প্রায় ৩ মাইলের হাইকিং পথ ধরে যাত্রা শুরু করলাম। ‘উল্ফরাঞ্চ’–এর পাশ দিয়ে এর ট্রেল হেড। খ্রিস্টীয় ১৮ শতকের শেষ দিকে জন ওয়েলেসলি উল্ফ নামের এক সিভিলওয়ার যোদ্ধা এটি তৈরি করেন। তাই এমন নামকরণ। হাইক করে আমরা পৌঁছলাম আপার ভিউ পয়েন্টে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪ হাজার ৮২৯ ফুট উঁচু। হাল্কা হলদেটে কমলা রঙের রিংটি কোনও কিছুর সাহায্য ছাড়াই ৩৬০ ডিগ্রি বেঁকে গিয়ে আর্চের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রায় ৬০ ফুট উঁচু।
ডেলিকেট আর্চ
ডেলিকেট আর্চ দেখে আমরা যাব ডেভিলস গার্ডেনের দিকে।ভিজিটর সেন্টার থেকে ১৫ মাইল উত্তরে পার্কের শেষ প্রান্তে রয়েছে ডেভিলস গার্ডেনের ট্রেল হেডটি। সুন্দর সাজানোগোঠানো।রয়েছে ক্যাম্পগ্রাউণ্ড, অ্যাম্ফিথিয়েটারও।সেই সঙ্গে দেড়শো পার্কিংলট।সব মিলিয়ে সাত রকমের আর্চ দেখতে পাওয়া যায় এখানে—ল্যান্ডস্কেপ, টানেল, পাইন ট্রি, পার্টিশন, নাবাহ, ডাবল এবং ডার্ক এঞ্জেল। সেই সঙ্গে রয়েছে রঙের খেলা!কোথাও সাদাটে, তো কোথাও আবার হাল্কাহলদেটে। তবে বেশিরভাগই শিলার গায়ে লাল আভা!
গোটা ডেভিলস গার্ডেন জুড়ে রয়েছে নানা উচ্চতার হুডুজ, বোল্ডার, সারি সারি মনোলিথ,শিলাগাত্রে গড়ে ওঠা বিভিন্ন মাপের ফটক এবং দলবেঁধে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মন্দিরের চূড়ার মতো শিলাস্তম্ভ।পার্কটি লবণভূমির উপরে গড়ে উঠেছে বলে শিলার গঠন এমন।ট্রেল হেড থেকে হেঁটে পৌঁছলাম ল্যান্ডস্কেপ আর্চে। নীল আকাশের নীচে লাল পাথরের অদ্ভুত ভূমি, চারদিকে শুধু জংলিফুলের গাছ এবং ঘাস। তার মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে ল্যান্ডস্কেপ আর্চ—ডেভিলস গার্ডেনের মূল আকর্ষণ।
ডাবল ও আর্চ ট্রেইল
ছবি তোলা শেষ করে এগোলাম ডাবল ও আর্চ ট্রেইলের দিকে। সমস্ত ট্রেলগুলির মধ্যে কঠিনতম হাইকিং পথ। সমতল বালিময় ভূমির উপর দিয়ে হেঁটে পৌঁছলাম ডাবল ও আর্চ ট্রেল হেডে। খাড়া ঢালের উপর দিয়ে হামাগুড়িদিয়ে উৎসাহিত মানুষকে মেন পয়েন্টের দিকে এগোতে দেখলাম। তাতে সাহস না পেয়ে প্রিমিটিভ ট্রেল হয়ে পাইন ট্রি আর্চ এবং টানেল আর্চের দিকে এগোলাম আমরা।
অল্প সময়ে এতকিছু দেখে তৃপ্তি হল বটে। তবে একটা আফসোস থেকে গিয়েছিল!পার্কে ঢোকার সময় একটা পয়েন্ট মিস করেছিলাম।‘গার্ডেন অব ইডেন’বিভাগের বিখ্যাত ডাবল আর্চ। ফেরার তাড়া ছিল যদিও,তবুও ছু্টলাম।
ডেভিলস গার্ডেন থেকে মূল রাস্তা ধরে এগিয়ে ‘গার্ডেন অব ইডেন’ পড়ল বাঁ দিকের গলিপথে। আর্চটি বেশ চমৎকার! বৃষ্টির জল বালি পাথরের শিলাস্তম্ভের মধ্যে ঢুকে ভিতর থেকে ক্ষয়ে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। পার্কিং এলাকা থেকে পায়ে হেঁটে আমরা পৌঁছলাম সেই প্রেক্ষাপটে যা, ১৯৮৯-এর বিখ্যাত হলিউড ছবি ‘ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যন্ড দ্য লাস্ট ক্রুসেড’–এরওপেনিং দৃশ্যে ব্যাকড্রপ হিসাবে দেখানো হয়েছিল।
ল্যান্ডস্কেপ আর্চ
খুবই কম সময় সেখানে থাকা হল। তাই মনটা ভার! ফের ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি নিয়ে বিদায় জানালাম রেড রক ক্যানিয়ন আর্চেসকে।
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.