লাচুং
গ্যাংটক থেকে খুব সকালে গাড়ি ছাড়বে উত্তর সিকিম অভিমুখে। উত্তর সিকিমের এই সফর সবটাই হয় সাধারণত প্যাকেজ ট্যুরের মাধ্যমে। অর্থাৎ গাড়ি, হোটেল, খাওয়াদাওয়া সব মিলিয়ে মাথাপিছু একটা মূল্য ধার্য হবে। উত্তর সিকিমের যাত্রীদের অনুমতিপত্র সঙ্গে থাকাটা জরুরি। অনুমতি পাওয়া যায় গ্যাংটক থেকেই। ভোটার বা আধার কার্ডের ফটোকপি ও দু’কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি নিয়ে আবেদন করলে সহজেই মেলে এই অনুমতিপত্র। গ্যাংটকে যে হোটেলে রাত্রিবাস করবেন, সেখানে ডকুমেন্টগুলি জমা দিলে তারাই আনিয়ে দেবে এই অনুমতিপত্র। গ্যাংটকের যে কোনও পর্যটন সংস্থার অফিসে যোগাযোগ করলে তারাও এই অনুমতিপত্র পাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে।
উত্তর সিকিমের অসাধারণ রূপ।
ভোরবেলা গ্যাংটক থেকে যাত্রা শুরু করে তাশি ভিউ পয়েন্ট, কাবি, ফোদং, মংগন, সিংঘিক পেরিয়ে পৌঁছে যাবেন চুংথাং। পথে পড়বে ফোদং গুম্ফা ও সেভেন সিস্টার্স ফল্স। ছবি তোলার জন্য কিছু সময় থামা যেতেই পারে এই দু’টি দ্রষ্টব্যের কাছে। চুংথাং জায়গাটি এই অঞ্চলে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ জনপদ।
লাচুং থেকে বয়ে আসা লাচুং-চু (চু মানে নদী) ও লাচেন থেকে বয়ে আসা লাচেন-চু নদী দু’টি এখানেই মিশে, তিস্তা নাম নিয়ে বয়ে গিয়েছে নীচের দিকে। বিরাট এক সামরিক ছাউনি রয়েছে এখানে। আছে বেশ কিছু দোকানপাট ও হোটেলও।
চুংথাং থেকে ২২ কিলোমিটার, অর্থাৎ গ্যাংটক থেকে ১১৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত লাচুং গ্রামে পৌঁছনোর পথে সারাক্ষণ সঙ্গ দেবে লাচুং-চু। ৮৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত লাচুং গ্রামটি বেশ সমৃদ্ধ। মূলত লাচুং-পা সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন এখানে। উঁচু পাহাড়ে ঘেরা নিসর্গে শোভাবৃদ্ধি করে সুন্দরী ঝর্না। হাতে সময় থাকলে দেখে নিতে পারেন লাচুং গ্রামের কার্পেট বুনন কেন্দ্র (সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত খোলা থাকে) আর লাচুং গুম্ফা। অনেক সুন্দর ম্যুরাল ও প্রাচীন মূর্তি নজর কাড়বে এই গুম্ফায়।
ইয়ুমথাং
বরফে ঢাকা গাছপালা।
১১৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ইউমথাং-এর আর এক নাম হল ‘ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার’। এপ্রিল-মে মাসে এখানে যেন জলসা বসে যায় ফুলের। বিভিন্ন প্রজাতির রডোডেনড্রন, প্রিমুলা ও আরও নানা ধরনের ফুলের সমারোহে তখন সত্যিই নন্দনকানন হয়ে ওঠে এই উপত্যকা। শীতকালে এলে (ডিসেম্বর থেকে মার্চ) আবার এই উপত্যকাকেই দেখতে পাবেন এক অন্য রূপে। বরফের সাদা পোশাকে তখন আবৃত থাকে পুরো ইয়ুমথাং অঞ্চল। মনে হবে বুঝি তুষার সাম্রাজ্যেই এসে পড়েছি। উঁচু পাহাড়ের সারি, উপত্যকা, রাস্তাঘাট— সবই সে সময় ঢাকা থাকে পুরু বরফের আস্তরণে।
লাচুং থেকে ইয়ুমথাং ২৩ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। সবুজ উপত্যকার বুক চিরে বয়ে চলেছে উচ্ছ্বল নীলরঙা নদী। উপত্যকার শুরুতেই রয়েছে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ। বহু মানুষকে দেখবেন জলে শরীর ডুবিয়ে বসে থাকতে। বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগের নাকি নিরাময় হয় এই জলে, এমনটাই শোনা যায়। সবুজ বিস্তীর্ণ উপত্যকার দু’দিকে বিস্তৃত উঁচু পাহাড়ের প্রাচীর।
ইয়ুমথাং উপত্যকা।
উপত্যকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে, সবুজ ঘাসের কার্পেটের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে এ বারে পৌঁছে যান শিবমন্দির হয়ে ইয়ুমেসামডং। দূরত্ব ইয়ুমথাং থেকে ২৩ কিলোমিটার। এই অবধিই যাওয়ার অনুমতি মেলে পর্যটকদের। চিন সীমান্তের নৈকট্যের কারণে প্রতিরক্ষা বিভাগের নির্দেশে এখানেই যাত্রাপথের ইতি টানতে হয়।
১৫০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই ইয়ুমেসামডং এক অপূর্ব সুন্দর জায়গা। তুষারাবৃত ইয়ুমেসামডং-এর প্রাকৃতিক শোভা দেখে মুগ্ধতায় আবিষ্ট হন পর্যটকেরা।
একই পথে ফিরে আসতে হবে লাচুং-এ। হাতে সময় থাকলে ও ফৌজি অনুমতি পেলে লাচুং থেকে নদীর উপর সেতু অতিক্রম করে অন্য পথে যাওয়া যেতে পারে কাটাও।
দূরত্ব লাচুং থেকে ২৪ কিলোমিটার। তুষারাবৃত কাটাও পৌঁছে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন পর্যটকের দল। শুরু হয়ে যায় বরফ নিয়ে খেলা। তবে চিন সীমান্ত খুবই কাছে হওয়ার কারণে এ পথে অনুমতি পাওয়াটা খুবই সমস্যাজনক হয়ে পড়ে বেশির ভাগ সময়ে।
যাত্রাপথ
গ্যাংটক থেকে এক রাত্রি দু’দিনের প্যাকেজেই সাধারণত সংঘটিত হয় ইয়ুমথাং সফর। মাথাপিছু খরচ পড়ে ১৮০০-২৫০০ টাকা। এর মধ্যে গাড়িভাড়া, হোটেল খরচ, খাওয়াদাওয়া সবই অন্তর্ভুক্ত থাকে। গাড়ি ও হোটেলের মান হিসেবে খরচের তারতম্য হয়ে থাকে। তবে এই হিসেবের মধ্যে কিন্তু ইয়ুমেসামডং কিংবা কাটাও-এর খরচ ধরা থাকে না। সেগুলির জন্যে আলাদা খরচ পড়ে। গাড়িতে মোট ৮ জন যাবে, সেই ভিত্তিতেই এই খরচ। কম যাত্রী গেলে খরচও বাড়বে সেই অনুপাতে।
উত্তর সিকিমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অন্য মাত্রা যোগ করে এরাও।
লাচেন
ইয়ুমথাং-ইয়ুমেসামডং যাত্রীদের যেমন রাত্রিবাস করতে হয় লাচুং-এ, গুরুদোংমার লেক দেখতে যান যে সব পর্যটক, তাঁদের রাত্রিবাসের ঠিকানা হল লাচেন। চুংথাং থেকে লাচেন-চু জলধারাকে সঙ্গী করে পৌঁছে যান লাচেন গ্রামে। চুংথাং থেকে দূরত্ব ২৯ কিলোমিটার। গ্যাংটক থেকে চুংথাং-এর দূরত্ব ৯৬ কিলোমিটার। ৯৪০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত লাচেন গ্রামটি লাচুং-এর মতো বড় নয়। দেখে নিতে পারেন এখানকার গুম্ফাটিও। খানিকটা উঁচুতে অবস্থিত বলে গুম্ফাচত্বর থেকে পুরো লাচেন গ্রাম ও উপত্যকার এক সুন্দর ছবি চোখে পড়ে।গুরুদোংমার
গুরুদোংমার যাত্রীদের কাকভোরেই বেরিয়ে পড়তে হবে লাচেন থেকে। সাধারণত গুরুদোংমার লেক দেখে দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসতে হয় লাচেনে। যেহেতু দুপুরের পর থেকে অনেক সময় এখানকার আবহাওয়া খারাপ হয়, তাই ফৌজি চেকপোস্ট থেকেও কড়া নজরদারি চলে যাতে গুরুদোংমার যাত্রীদের গাড়ি ফিরতে বেশি দেরি না হয়। তা ছাড়া আরও একটি কারণ আছে। গুরুদোংমার প্যাকেজের যাত্রীরা সাধারণ ভাবে লেক দর্শন করে সে দিনই ফিরে যান গ্যাংটকে। তাই লাচেন থেকে বেরোতে দেরি হলে গ্যাংটক পৌঁছতেও অনেক রাত হয়ে যাবে।
গুরুদোংমার লেক।
লাচেন থেকে ৩১ কিলোমিটার দূরেই থাঙ্গু। যেতে যেতেই দেখতে পাবেন প্রকৃতির সবুজ রং ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আর তার জায়গা নিচ্ছে তিব্বতীয় মালভূমির রুক্ষ, ধূসর সৌন্দর্য। ১৩৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত থাঙ্গুতে ইচ্ছে করলে সেরে নিতে পারেন প্রাতরাশ। কয়েকটি ছোট দোকান আছে যেখানে চা, নুডলস্ ইত্যাদি মেলে। থাঙ্গু থেকে গুরুদোংমারগামী মূল রাস্তাটি ছেড়ে আলাদা হওয়া আর একটি রাস্তা ধরে যেতে পারেন চোপতা ভ্যালিতে। থাঙ্গু থেকে দূরত্ব মাত্রই দশ কিলোমিটার। ১৩২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই সুন্দর উপত্যকাটি দেখে আবার ফিরে আসতে হবে থাঙ্গুতেই। তবে গুরুদোংমার যাওয়ার পথে তাড়াতাড়ি যাওয়া-আসা নিয়ে যেহেতু কিছু জটিলতা আছে, তাই উচিত হবে গুরুদোংমার লেক দেখে থাঙ্গু ফিরে তার পর সেখান থেকে চোপতা ভ্যালি যাওয়া।
থাঙ্গু থেকে এ বার এক দৃষ্টিনন্দন পথ ধরে যাত্রা শুরু করে অবশেষে পৌঁছে যান গুরুদোংমার লেকের ধারে। থাঙ্গু থেকে লেকের দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার। ১৭৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই অনিন্দ্যসুন্দর সরোবরটি প্রথম দর্শনেই মন জয় করে নেবে। টলটলে নীল জলের সরোবরকে ঘিরে রেখেছে দুধসাদা তুষারশৃঙ্গের সারি। তাদের ছায়া জলে পড়ে তিরতির কাঁপে হাওয়ার দোলায়। বিভিন্ন আকৃতির বরফ যেমন ভেসে বেড়ায় লেকের জলে, তেমনই সুখে সেখানে সাঁতার দেয় ব্রাহ্মণী হাঁস-সহ অন্যান্য পরিযায়ী পাখির দল। জোরালো ঠান্ডা হাওয়ার দাপটে শৈত্যের অনুভূতিও ভাল ভাবেই টের পাওয়া যাবে। লেক বেষ্টন করে পায়ে চলা একটি পথ আছে, যেখান দিয়ে ইচ্ছে করলে পুরো লেকটিকেই প্রদক্ষিণ করে নিতে পারেন হাতে সময় থাকলে। গুরু পদ্মসম্ভবের স্মৃতিবিজড়িত এই লেকটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র বলে গণ্য হয়। বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ এই লেকটির অনবদ্য রূপ দেখে মোহিত হয়ে যান পর্যটকেরা।
তুষারাবৃত পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এ ভাবেই গড়ে উঠেছে জনবসতি।
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.