নামচি
৪৪০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত নামচি হল দক্ষিণ সিকিমের সদর শহর। স্বাভাবিক ভাবেই স্কুল-কলেজ, দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল, হোটেল— সব মিলিয়ে এক জমজমাট পাহাড়ি শহরের রূপেই সজ্জিত নামচি। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা সমেত অন্যান্য তুষারশৃঙ্গের অপরূপ দৃশ্য যেমন দেখা যায়, তেমনই চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ সবুজ উপত্যকার এক সুন্দর দৃশ্য। নামচি ও তার আশপাশের দর্শনীয় স্থানগুলি দেখতে অন্তত একটা গোটা দিন সময় লাগবে।
বংলার সুদৃশ্য বুদ্ধপার্ক।
শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত সামদ্রুপচে। এখানে ১৩৫ ফুট উঁচু গুরু পদ্মসম্ভবের মূর্তিটি সত্যিই দেখার মতো। সামদ্রুপচের ঠিক নীচের ঢালেই রয়েছে রক গার্ডেন। সুন্দর এই পিকনিক স্পটটিও দেখে নিন একযাত্রাতেই। এর পর আলে গুম্ফা, বাইচুং স্টেডিয়াম দেখে চলে যান সোলোফোকে। এখানেই গড়ে উঠেছে সেই বিখ্যাত ‘চারধাম’। নামচি শহর থেকে দূরত্ব মাত্রই ৫ কিলোমিটার। ২০১১ সালে ৫৬ একর জমির উপর নির্মিত হয়েছিল এই চারধাম।
ভারতের চারপ্রান্তের চারটি বিখ্যাত মন্দিরের অনুকরণে এখানে নির্মাণ হয়েছে। উত্তরাখণ্ডের বদ্রীনাথ, গুজরাতের দ্বারকা, পুরীর জগন্নাথধাম (সব ক’টিই বিষ্ণুমন্দির) ও তামিলনাড়ুর রামেশ্বরম (শিবমন্দির) মন্দির। এ ছাড়া একটি ১০৮ ফুট উঁচু শিবমন্দির রয়েছে যার উপরে অধিষ্ঠিত আছেন ৮৭ ফুট উচ্চতার শিবমূর্তি। রকমারি ফুলের বাগান দিয়ে ঘেরা জায়গাটি বর্তমানে এক জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে উঠেছে।
হেলিপ্যাড গ্রাউন্ড থেকে নির্মেঘ আকাশে তুষারশৃঙ্গের এক মনোরম দৃশ্য চোখে পড়ে। সেখান থেকে চলে আসুন তারেভির। নামচি শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই তারেভির হল প্রকৃতপক্ষে মোরগঝুঁটির মতো দেখতে একটা ক্লিফ। এখান থেকে উন্মুক্ত চরাচরে বহু দূর পর্যন্ত চোখ চলে যায়। সবুজ নদী উপত্যকার মনোরম দৃশ্য, তিস্তা ও রঙ্গিত নদীর সঙ্গম, পাহাড়ের ঢালে চা-বাগানের সৌন্দর্য, সবই দেখতে পাবেন ভিউপয়েন্টে দাঁড়িয়ে। ক্লিফের উপর বাঁধানো রাস্তা ধরে (অনেকটা যেন চিনের প্রাচীর) শেষ প্রান্ত পর্যন্ত চলেও যেতে পারেন পায়ে হেঁটে। অপূর্ব দৃশ্য দেখতে পাবেন সেখান থেকেও।
চারটি বিখ্যাত মন্দিরের অনুকরণে তৈরি চারধাম।
নামচি থেকে খুব কাছেই অবস্থিত টেমি টি গার্ডেন। দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। পাহাড়ের ঢালে তরঙ্গায়িত চা-বাগানের চোখজুড়নো দৃশ্য আকৃষ্ট করবেই।
যাত্রাপথ
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে নামচির দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার। পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় ৩ ঘণ্টা। পুরো গাড়ি রিজার্ভ করলে ভাড়া পড়বে ৩০০০-৩৫০০ টাকা। কম খরচে আসতে চাইলে শিলিগুড়ি এসএনটি বাসস্ট্যান্ড থেকে শেয়ার জিপে নামচি আসতে পারেন। মাথাপিছু ভাড়া পড়বে ১৫০-২০০ টাকা। নামচি থেকে রাবংলার দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার, গ্যাংটকের দূরত্ব হল ৮০ কিলোমিটার।রাত্রিবাস
নামচিতে সোলোফোক রোডে থাকতে পারেন (এখান থেকে ‘চারধাম’ কাছেই)। ‘হোটেল প্যাঙ্গোলিন’- দ্বিশয্যাঘরের ভাড়া ২০০০-২৫০০ টাকা, ত্রিশয্যাঘরের ভাড়া ৩০০০ টাকা, স্যুইট রুমের ভাড়া ৩৫০০ টাকা। যোগাযোগ: ৯৯৩২৫১১৫২৬, ৯৫৬৪৬১৬৯৩৫রাবংলা
গুরু পদ্মসম্ভবের মূর্তি।
‘এখানে মেঘ গাভীর মত চরে’। রাবংলা সম্পর্কে এই কথাটা খুব খেটে যায়। এই রোদ তো এই বৃষ্টি। সুউচ্চ মৈনাম পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত হওয়ায়, জলভরা মেঘ মৈনাম পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে মাঝেমধ্যেই বৃষ্টিপাত ঘটায় এই অঞ্চলে। ৭০১৬ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত রাবংলা দক্ষিণ সিকিমের সর্বোচ্চ পর্যটনকেন্দ্র। মাউন্ট নরসিং, পান্ডিম-সহ অন্যান্য তুষারশৃঙ্গের সুন্দর দৃশ্য চোখে পড়বে রাবংলা থেকে।
তবে সেই দৃশ্য যদি আরও ভাল ভাবে উপভোগ করতে চান, তবে পায়ে হেঁটে উঠে আসতে হবে ওই মৈনাম পাহাড়চূড়ায়। গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া এই পথে স্থানীয় গাইড দরকার, নয়তো পথ হারানোর ভয় থাকে। দুর্গম পথে ঘণ্টা পাঁচেক হাঁটাটা একটু কষ্টকর মনে হতে পারে, কিন্তু মৈনামশীর্ষে দাঁড়িয়ে হিমালয়ের বিস্তৃত তুষারশৃঙ্গরাজির যে অনবদ্য দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠবে, তাতে কষ্ট করাটা সার্থক হয়েছে বলেই মনে হবে। এখান থেকে আরো ঘণ্টাখানেকের হাঁটায় পৌঁছে যাওয়া যায় ভ্যালেদুঙ্গা-য়। এটিও প্রকৃতপক্ষে একটি ক্লিফ। এখান থেকেও তুষারশৃঙ্গের দৃশ্য চমৎকার।
রাবংলা থেকে তুষারশৃঙ্গ।
ট্রেকিংয়ের কষ্টটা যদি না করতে চান তবে গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ুন সাইট-সিয়িং করতে। নবনির্মিত সুদৃশ্য বুদ্ধপার্ক, রালং মনাস্ট্রি, তিব্বতি উদ্বাস্তুদের হ্যান্ডিক্র্যাফ্টস সেন্টার, রাবংলা মনাস্ট্রি ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান ঘুরে নিন একযাত্রায়।
যাত্রাপথ
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে রাবংলার দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার। পুরো গাড়ি রিজার্ভ করলে ভাড়া পড়বে ৩৫০০-৪০০০ টাকা। শিলিগুড়ি এসএনটি বাসস্ট্যান্ড থেকে শেয়ার জিপে এলে মাথাপিছু ভাড়া পড়বে ২৫০-৩০০ টাকা। ওখান থেকে বাসও পাবেন রাবংলার। ভাড়া ১৫০ টাকা। সাইটসিয়িং-এ খরচ পড়বে ২৫০০ টাকা (পুরো গাড়ি)।
ছামথিং দিয়ে বয়ে চলা তিস্তা নদী।
ছালামথাং
দক্ষিণ সিকিমের এক নতুন পর্যটনকেন্দ্র হল এই ছালামথাং। ৫৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ছালামথাং সিকিমের এক গ্রাম্য ছবি তুলে ধরে পর্যটকদের সামনে। ভারী সুন্দর সেই গ্রামের ছবি। ছড়িয়ে থাকা সুদৃশ্য ছোট ছোট বাড়ি, লাগোয়া খেতে ফলে আছে জৈবসারে ফলানো আলু, মুলো, সিম, চালকুমড়ো, বেগুন ইত্যাদি আনাজ। জৈব পদ্ধতিতে ফলানো সেই সব সুস্বাদু আনাজ দিয়ে যখন মধ্যাহ্নভোজ কিংবা নৈশাহার সারবেন, তখন রসনাতৃপ্তি যে মোক্ষম হবে সেটা বলাই বাহুল্য। থাকার জন্য কোনও হোটেল নেই এখানে। হোমস্টেতেই হবে রাত্রিবাস। কিন্তু সেখানকার ব্যবস্থাপনা যথেষ্টই স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ও আরামদায়ক। সর্বোপরি তাদের উষ্ণ আতিথেয়তা মুগ্ধ করবে প্রতি মুহূর্তে। খড়ের ছাউনি দেওয়া মাচানঘরে বসে চা-কফি পান করতে করতে দেখতে পাবেন দূরে তুষারাবৃত গিরিশ্রেণি, সবুজ উপত্যকার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা তিস্তা নদীর অপরূপ দৃশ্য।
ছালামথাং গ্রাম।
এখানে কিছু পথ পায়ে হেঁটে দেখে নেওয়া যায় কয়েকটি দ্রষ্টব্য। জঙ্গলাকীর্ণ সেই পথে অবশ্যই সঙ্গে থাকবে স্থানীয় গাইড। বন্ঝাক্রি গুহা, রক গার্ডেন, রামিতে ভিউপয়েন্ট, ঝর্না ইত্যাদি ঘুরে দেখাটা বেশ আনন্দদায়ক হবে। গাড়িভাড়া করেও দেখে নেওয়া যায় আশপাশের আরও কিছু দর্শনীয় স্থান।
নবনির্মিত কারুকার্যময় রাধাকৃষ্ণ মন্দির ‘মঙ্গলধাম’, ১৬০ বছরের প্রাচীন হেরিটেজ হাউস, রসাইলি ভিউপয়েন্ট, দেওরালি ভিউপয়েন্ট, লাভদাঁড়া ভিউপয়েন্ট ইত্যাদি জায়গাগুলি মুগ্ধ করবে পর্যটকদের।
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.