মধ্যপ্রদেশের অন্দরে মহাকাল দর্শন (Travel Story of Mahakal in Madhya Pradesh-India)

শহর জুড়ে দুটো গন্ধ— ধূপ আর দুধ। ভিতরে যত ঢুকছি, তত বাড়ছে। অটোয় চেপে হোটেলে যাওয়ার পথে এমন কোনও রাস্তা-গলি পড়ল না, যেখানে মন্দির বা মিষ্টির দোকান নেই। মন্দির থাকলেই ভেসে আসছে রকমারি ধূপের গন্ধ। আর মিষ্টির দোকান মানেই সামনে বড় পাতিলায় ফুটে ঘন হচ্ছে দুধ। মহাকালের ভরসায় বেঁচে থাকা শহর উজ্জয়িনীর রূপ, বর্ণ তো আছেই, সঙ্গে গন্ধটাও প্রকট।
 
ভীমবেটকার গহীনে।

সাত দিনের মধ্যপ্রদেশ ভ্রমণের শেষে গিয়েছিলাম উজ্জয়িনী। যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই জবাব মিলছিল এখানে দর্শনের জায়গা একটাই, দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম মহাকালেশ্বর।
কেউ কেউ তার সঙ্গে কালভৈরবের মন্দির, গোপালজিউ মন্দির, রামঘাটের কথাও বলেছিলেন। আসলে নর্মদার ঘাটের ধারে প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো এ শহরের ধর্মীয় প্রাধান্যটাই বেশি। রুজি-রোজগার থেকে অবসর, এ শহরের মানুষ বেঁচে আছেন ধর্মকে ধরেই।

১২ বছর অন্তর কুম্ভ হয় এ শহরে, শিপ্রা নদীর তীরে রামঘাটে। বাকি সময় সে স্মৃতি বয়ে চলে শহর। শহরবাসীদের বিশ্বাস, ভোলানাথের শহরে কাউকে নিষেধ করতে নেই। ফলে মন্দিরে, রাস্তায় অবাধ ঘোরে গরু। মহাকালের মন্দিরে রয়েছে হাতিও। শহর ‘স্বচ্ছ’ করার চেষ্টা থাকলেও বাধাহীন গোমাতাদের পদচারণায় তা মুশকিল বটে.!

 যাত্রা শুরুর আগে চেনাজানা সকলে বলেছিলেন, সাত দিনে মধ্যপ্রদেশ দেখা যায় না। তাই আমরা বেছে নিয়েছিলাম কয়েকটা জায়গা। ভোপালে যাত্রা শুরু। সেখানে দেড় দিন থেকে পৌঁছই ভোজপুর। রাজা ভোজের আমলে তৈরি ভোজরাজেশ্বর শিব মন্দিরই মূল। মন্দিরটি অসম্পূর্ণ। কথিত আছে, এ মন্দির তৈরির সময়েই যুদ্ধে নিহত হন রাজা। মন্দিরের কাজ, পাশের বেতোয়া নদীর উপরে বাঁধ সবই পড়ে থাকে অসম্পূর্ণ। উঁচু মন্দিরের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত ফুটের একটাই পাথরে তৈরি শিবলিঙ্গ অবাক করে। মন্দিরে ঢোকার দরজার দু’পাশে গঙ্গা, যমুনার মূর্তিও সচরাচর দেখা যায় না। পুরো মন্দিরটাই একটা পাথরের চাতালে গড়া। মন্দির চত্বরে তো বটেই, এই গ্রামে ঘুরলেও দেখা যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু মূর্তি, স্থাপত্যকীর্তি। জানা যায়, এ সবই মন্দিরে বসানোর কথা ছিল। নষ্টও হয়ে গিয়েছে বহু মূর্তি।

ভোজপুর থেকে গাড়িতে রওনা দিই ভীমবেটকা। ঘণ্টাখানেকের পথ পুরোটাই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ভরা। ভীমবেটকার গুহাগুলিতে প্রস্তর যুগের একেবারে গোড়ার দিকের কিছু হাতে আঁকা ছবি দেখা যায়। কিছু গুহাচিত্র কম করে তিরিশ হাজার বছর পুরনো। ২০০৩ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তকমা পাওয়া ভীমবেটকা একেবারেই অন্য সময়ে নিয়ে গিয়ে ফেলে। সামনের কিছু গুহায় সরকারের উদ্যোগে পাথরের মূর্তি বসিয়ে দেখানো হয়েছে গুহায় কী ভাবে জীবন চলত। সেগুলো পেরিয়ে জঙ্গলের আরও ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে মনে হয়, এ পথ শুধু টেনেই নিয়েই যায়। যেমনটা গিয়েছিলাম, তেমন ভাবে ফিরে আসা যায় না বোধহয়!
টুপটাপ বৃষ্টি, পাহাড়ি ঝোরা, সবুজ, আরও ঘন সবুজকে সঙ্গী করে হাঁটা। কোনও গাইড নেই, পথ বলে দেওয়া বা জিজ্ঞেস করার লোক নেই। একটানা পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে পথ চলা। সরকারি পাহারাদার বলে দিয়েছিলেন, এখানেই পাথরের সমান্তরাল খাঁজে নাকি মৃতদের শুইয়ে রেখে যেত জীবিতরা। এক পাহাড়ে জীবন, আর একটায় মৃত্যু, পাশাপাশি।

গুহাচিত্রের একেবারে পুরনো ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে মূলত বিশালকায় জন্তু। গন্ডার, বাইসনের ছবির মতো। বেশির ভাগই লালচে বা সবজেটে রঙের পাথর ঘষে আঁকা। আবার পরবর্তী সময়ের (মধ্য প্রস্তর যুগ) ছবিতে দল বেঁধে শিকারে যাওয়া মানুষ বা গৃহস্থালির ছবি। বোঝা যায়, দল বাঁধাটা মানুষের সহজাত। বেশ কিছু অস্ত্রের ছবিরও দেখা মেলে। ছোটবেলার ইতিহাস বইয়ের ছবির মতো অনেকটা। প্রশ্ন জাগে, নামটা ভীমবেটকা কেন! ভীমবেটকার সঙ্গে মহাভারতের ভীমের গল্পও জড়িয়ে। জনশ্রুতি, এই গুহায় ভীমের যাওয়া-আসা ছিল। ভীমের বসার জায়গা বা ‘ভীমবৈঠক’ থেকেই নাম ভীমবেটকা।

গুহাচিত্রে জীবনযাপনের দৃশ্য

ভীমবেটকা থেকে রওনা দিই পাঁচমারি। পাহাড়ের ঢালে হোটেলে পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে যায়। লোকে বলে, পাঁচমারি জুড়ে ভোলানাথের বাস। সত্যিই পাহাড়ের খাঁজে বড় মহাদেব, গুপ্ত মহাদেব দেখতে গিয়ে শিহরন জাগে। যে সময়ে গিয়েছিলাম, বৃষ্টি পিছু ছাড়েনি। কুয়াশা, ছিপছিপে বৃষ্টিতে অন্য ভ্রমণপিপাসু তেমন ছিলেন না। জটাশঙ্কর দেখতে গিয়ে নির্জন পাহাড়ের ফাঁকে এক মহিলার নিজের ছন্দে গাওয়া শিবের গান নেশা ধরায়। গুপ্ত মহাদেবের সংকীর্ণ গুহায় ঢোকার সময়ে মনে হয়েছিল, আটকেই যাব বোধহয়। কোনও রকমে ঢোকার পরে পূজারি বলেছিলেন, ‘‘ভগবানের কাছে আসাটাই কঠিন। ফেরাটা চাইলেই হয়।’’ পাঁচমারি থেকেই পিপরিয়া হয়ে এসেছিলাম উজ্জয়িনী। পিপরিয়াও পাহাড়ি জায়গা। মোলায়েম রাস্তা, দু’পাশে ঝোরা।

তবে বেখেয়ালে বেড়ানো যে কী, বুঝেছিলাম এখানেই। পিপরিয়া থেকে রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ ট্রেনে উঠে সকালে উজ্জয়িনী পৌঁছনোর কথা। ভুল করে এক দিন আগের টিকিট কেটেছিলাম। আসলে রাত ১২টার পরের ট্রেন মানে যে পরের দিনের তারিখ, খেয়াল করিনি। মাসুল দিলাম ট্রেনে উঠে। বাতানুকূল কামরায় ঘুমে কাতর যাত্রীকে দিব্যি উঠিয়ে বলেছিলাম, ‘আরে, আমাদের সিটে শুয়ে আছেন কেন?’ বাঙালির রোয়াব দেখিয়ে নিজেই টিটিকে ডেকে এনেছিলাম। তার পরে টিকিট দেখাতেই মাথায় হাত। আমাদের টিকিট আগের রাতের! কোনও রকমে বুঝিয়ে, ওই কামরাতেই সিট  জোগাড় করে ফেলেছিলাম। ভাষা আলাদা, জীবনযাপনের ঢং আলাদা, কিন্তু মুলুক তো একই! বলতে বাধা নেই, ওই টিটিই উজ্জয়িনী স্টেশনে পাহারাদারদের চোখ এড়িয়ে বার করে অটোয় উঠিয়ে দেন আমাদের।

মনে রাখুন...

হাওড়া থেকে ট্রেনে ভোপাল। গাড়িতে ভোজেশ্বর। ভোজেশ্বর থেকে ভীমবেটকা গাড়িতেই আরও এক ঘণ্টা। সেখান থেকে পাঁচমারি গাড়িতে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। চোখজুড়ানো রাস্তা। পাঁচমারির কাছাকাছি রেল স্টেশন পিপারিয়া, সেখান থেকেই উজ্জয়িনী। প্রতি ঋতুতে আলাদা রূপ। শীতে পাঁচমারি, ভীমবেটকা তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যায়।

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.

[blogger]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget